তারপর তাকে অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে তার বোনের বাড়িতে যেতে রাজি করাই । আমি তাকে বাবার বাড়িতে যেতেই বলেছিলাম। কিন্তু শামারোখ বলল, ময়না মানে তার বড় ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে কয়েকদিন থেকে ঝগড়া চলছে। উপস্থিত মুহূর্তে সেই অগ্নিকুণ্ডে ফিরে যাওয়ার তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও নেই । বোনের বাড়িতে যেতেও রাজি করাতে অনেক সাধ্যসাধনা করতে হয়েছে। শামায়োখ বলল, আপনিও মিষ্টি কথায় আমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিচ্ছেন। আমি ভেবেছিলাম আপনি লোকটা ভাল। এখন দেখছি, আপনিও অন্য দশটা পুরুষ মানুষের মতো। আমি আমার দুর্বলতার কথাটা প্রকাশ করে ফেলেছি, এখন আপনি আমাকে নোংরা আবর্জনার মতো দূরে ছুঁড়ে ফেলতে পারেন। আমি বললাম, ব্যাপারটা মোটেই সে রকম নয়। ধরুন, আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হলো। আজ যদি এই ঘরে আপনি রাত কাটান, আর সে কথাটা যদি ছড়িয়ে যায়, আপনার আমার দুজনের সামাজিক সম্মানের জন্য কাজটা মোটেও ভাল হবে না। শামায়োখ ফুঁসে উঠে বলল, সমাজ আমাকে খাওয়ায়
পরায়, যে আমি সমাজের ধার ধারব? আমি বললাম, আপনি যখন সমাজে বাস করবেন, আপনাকে সমাজের ধার ধারতেই হবে। সমাজ যখন আক্রমণ করে, সেটা অবহেলা করে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু আঘাতটা গায়ে ঠিকই বাজবে। শামারোখ এবার নরম হয়ে এল। ঝোলা থেকে চিরুনি বের করে এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে নিল। শাড়িটা ভাল করে পরল। দুজনে হেঁটে গিয়ে একটা রিকশায় চড়ে বসলাম। দুজনের মধ্যে কোনো কথা হলো না। নীলক্ষেত ছাড়িয়ে যাওয়ার পর শামারোখ আমার কাঁধের ওপর তার ক্লান্ত মাথাটা রাখল।
ধানমন্ডিতে তার বোনের বাড়িতে শামারোখকে রেখে আসার পর আমি সরাসরি ঘরে ফিরতে পারলাম না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিংয়ের সামনে হাঁটতে আরম্ভ করলাম। কতবার যে এ-মাথা ও-মাথা করেছি, তার কোনো হিসেব নেই। বাইরে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে । আমার গায়ে কোনো শীতের কাপড় নেই। তবু আমি খুব গরম অনুভব করছিলাম। ওই একটা দিনের মধ্যে আমার বয়স যেন অনেক বেড়ে গেছে। পরস্পর বিপরীতমুখী চিন্তার ঘাত-প্রতিঘাতে আমার কাঁধ দুটো নুয়ে আসছিল। আমি কি করব, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
এই মহিলাটি আমাকে ভালোবাসে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হলাম। প্রাণ থেকে ভাল বাসলে এতখানি এগিয়ে এসে এরকম একটি প্রস্তাব করতে পারত না। এই অপরূপ সুন্দর মহিলার কি নেই, সবইতো আছে। তার গানের গলা চমৎকার। তার কবিতার মধ্যে মেধা ঝিলিমিলিয়ে জ্বলতে থাকে। মনে দয়ামায়া আছে। এরকম একজন সুলক্ষণা নারীর জন্য সেকালের রাজারা যুদ্ধ করতেও কুণ্ঠিত হতেন না । একটা মাত্র ইঙ্গিতে এই নগরীর ধনবান, রূপবান এবং বিদ্বান ব্যক্তিরা কীভাবে ছুটে এসে তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে, সে দৃশ্য আমি অনেকবার দেখেছি।
আমার নিঃসঙ্গ জীবনের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, শামারোখ এক দুপুরবেলা আপনা থেকেই এসে আমার আধ-ময়লা বিছানায় দুপুর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত ঘুমিয়েছিল, তার জীবনের মর্মান্তিক পরাজয়গুলোর কথা আমার কাছে প্রকাশ করে অঝোরে কেঁদেছিল। তারপর নিজের মুখেই আমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করেছিল। আমার মৃত্যুর পূর্ব-মূহূর্ত পর্যন্তও এই ঘটনাটি দীপ্তিমান হীরক খণ্ডের মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকবে। কী সৌভাগ্যবান আমি, মনে হচ্ছিল, আমি হাত বাড়িয়ে আকাশের তারাগুলো ছুঁয়ে ফেলতে পারি। শামারোখ আমার ভেতরে একটা অগ্ন্যুৎপাত ঘটিয়ে দিয়ে গিয়েছে।
পাশাপাশি বিপরীত একটা চিন্তার ধারাও আমার মনে প্রবাহিত হচ্ছিল। ওই মহিলাকে রাজার ঘরে মানায়। যার দোতলা বাড়ি আছে, বাড়ির সামনে লন আছে, লনের একপাশে বাগান আছে, গ্যারেজে হাল মডেলের গাড়ি আছে, গেটের সামনে দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকে, আসতে-যেতে মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম ঠোকে, সেই রকম একটি বাড়িতে এই মহিলাকে চমৎকার মানায়। বিদেশী ফার্নিচার ভর্তি ড্রয়িং রুমের কার্পেটের ওপর লঘু চরণ ফেলে এই মহিলা চলাফেরা করবে, তার পায়ের ছোঁয়ায় কার্পেটের বাঘ জীবন পেয়ে আবার পায়ের কাছেই অনুগত সেবকের মতো লুটিয়ে পড়বে। এই মহিলা আমাকে বিয়ে করতে পারে, কিন্তু তাকে নিয়ে আমি কি করব? ধরে নিলাম, মহিলার সঙ্গে আমার বিয়ে হলো। মহিলা আমাকে নিয়ে একদিন-না একদিন তার পুরুষ বন্ধুদের সামনে হাজির করবে। আমার গ্রামীণ করুণ চেহারা নিয়ে তারা আমাকে ভ্যাঙচাবে। হতে পারে শামারোখ আমার অপমানকে তার নিজের অপমান বলবে, এই কুত্তার বাচ্চাদের সঙ্গে লড়াই করে প্রমাণ কর যে তুমি তাদের চাইতেও যোগ্য পুরুষ। আমি পুরুষ বটে, কিন্তু ও নিয়ে আমার বিশেষ গর্ববোধ নেই। আমি অত্যন্ত ভীতু মানুষ, ঝগড়া-ঝাটি করাও আমার ধাতে নেই। সুতরাং শামারোখের খাতিরেও কারো সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া আমার পোষাবে না ।
শামারোখ ভালোবাসতে জানে, একথা অস্বীকার করি নে। তার সৌন্দর্য, তার রুচিবোধ, তার শিক্ষা কারো কাছে নগদ মূল্যে বিক্রি করার প্রবৃত্তি শামায়োখের হবে না, সে কথা আমি ভালভাবেই জানি। কিন্তু শামারোখের ব্যক্তিত্ব আর চরিত্রের আরো একটা দিক সম্পর্কে আমি জানি। শামারোখ ভালোবাসার কাছে যতই অসহায় বোধ করুক কিন্তু তার যে বিশেষ মূল্য আছে, সেটা সে মর্মে অনুভব করে। তার মনের একটা কামনা পুরুষ মানুষেরা তাকে নিয়ে পরস্পর শক্তি-পরীক্ষায় অবতীর্ণ হোক। এই দৃশ্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করে সে ভীষণ আনন্দ পেয়ে থাকে। সব জেনে-শুনেও শামারোখের এই ইঁদুর-ধরা কলে আমি কী করে ঢুকে পড়ি।