তার প্রস্তাবটা শুনে আমি কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলাম না। আমি স্বপ্নেও ভাবি নি মহিলার মুখ দিয়ে এরকম একটা কথা বেরিয়ে আসবে। আমি যদি উল্লসিত হয়ে উঠতে পারতাম, সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ বলতে পারতাম, সেটাই সবচেয়ে ভাল হতো। কিন্তু বিয়ে করতে রাজি হওয়ার কথায়, একরাশ দ্বিধা আমাকে জড়িয়ে ধরল। শামারোখের মনে আঘাত দেয়ারও ইচ্ছে আমার ছিল না, বিশেষ করে ওই অবস্থায়। আমি বললাম, শামারোখ, আপনি যে কোনো পুরুষ মানুষকে বিয়ে করতে বললে নিজেকে তার ভাগ্যবান মনে করার কথা। আমার মতো একজন নগণ্য মানুষের কাছে কথাটা বলেছেন, সেজন্য আমি নিজেকে খুবই ধন্য মনে করছি। আপনার মুখে এই অপূর্ব কথা শুনলাম, আমার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে। আপনার আর আমার মধ্যে যদি কিছু নাও ঘটে শুধু ওই কথাটি আমার সারাজীবনের স্মৃতি হয়ে থাকবে। আমাকে খুব কাছের এবং নির্ভরযোগ্য মানুষ মনে করেন বলেই এমন কথাটি বলতে পারলেন। কিন্তু তার আগে আমি যদি বর্তমান দুঃখের কারণটা জানতে চাই, আপনাকে কি খুব আহত করব? শামারোখ ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর মৃদুকণ্ঠে বলল, আপনাকে জানাতে আমার আপত্তি নেই।
তার কাহিনীটা সংক্ষেপে এইরকম: সোলেমান চৌধুরীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল বিলেতে। তারা পরস্পরের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। দুবছর এক ছাদের তলায় থেকেছেও। কথা ছিল দেশে এসে দুজন বিয়ে করবে। আমার এখানে আসা নিয়ে সোলেমানের সঙ্গে তার কিছুদিন খুব খিটিমিটি চলছিল । আসলে এটা একটা উপলক্ষ মাত্র। সোলেমান আরেকটা কম বয়সের মেয়ের সঙ্গে তলায় তলায় সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। শামারোখের বাড়ি যাওয়া-আসা করত। তাদের বাড়িতেই এই তরুণীর সঙ্গে সোলেমান চৌধুরীর পরিচয়। আমার সঙ্গে শামারোখের একটা বিশ্রী সম্পর্ক তৈরি হয়েছে এই অজুহাত তুলে আর্ট ইনস্টিটিউটের ছাত্রীটিকে বিয়ে করে ফেলেছে সোলেমান। আমাকে শামারোখ গ্রিন রোডের যে বাসায় নিয়ে গিয়েছিল, তার মালিক সোলেমান চৌধুরীর খালাতো ভাই। একজন বয়স্ক ঠিকাদার এবং বিবাহিত। এখন সেই আদিলই দাবি করছে, তুমি আমাকে বিয়ে কর, আমি আগের বউকে তালাক দেব। শামারোখ যদি তাকে স্বেচ্ছায় বিয়ে করতে রাজি না হয়, রাস্তাঘাট যেখানে থেকে পারে ধরে নিয়ে যাবে বলে হুমকি দিয়েছে। বাড়িতে শামারোখের বুড়ো বাবা এবং ছোট বোনটি ছাড়া কেউ নেই। কাহিনী শেষ করে সে বলল, আমি আবার একটু ঘুমোব। সে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
শামারোখ সেদিন সন্ধ্যেঅবধি আমার ঘরে ঘুমিয়েছিল। আমার অন্য এক জায়গায় যাওয়ার তাড়া ছিল। কিন্তু শামারোখের জন্য ঘর থেকে বের হওয়া আমার সম্ভব হয় নি। তাকে একা ঘুমন্ত অবস্থায় ফেলে আমি বাইরে যাই কী করে! সারাক্ষণ দরজা বন্ধ করে আমাকে ঘরের মধ্যে বসে থাকতে হলো। আমি ভয় পাচ্ছিলাম, কেউ যদি এসে পড়ে! ব্যাপারটা পাঁচ কান হয়ে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে আমাকে ভীষণ বেকায়দার মধ্যে পড়ে যেতে হবে। আমাকে অপছন্দ করার মানুষের অভাব নেই। তাদের কেউ যদি এই অবস্থায় শামারোখকে দেখে ফেলে, হোস্টেলে আমার সিটটা রক্ষা করাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
সাতটা বেজে গেল, এখনো শামায়োখের ঘুম ভাঙছে না। খুন করা লাশের পাশে খুনিকে পাহারা দিয়ে জেগে থাকতে হলে যে অবস্থা দাঁড়ায়, আমার দশাও এখন অনেকটা সেইরকম।
অবশেষে শামারোখের ঘুম ভাঙল। ঘুম ভাঙ্গল বুঝতে পারলাম, তার চোখ দুটো মেলেছে। শামারোখ অনেকক্ষণ ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে রইল। কোনো কথা বলছে না। আমি মনে মনে প্রমাদ গুণলাম। তার যা মনের অবস্থা, কোনো ধরনের অসুখ বিসুখ যদি ঘটে যায়, আমি কি করব! আমাদের এই পুরুষদের হোস্টেলে ভদ্রমহিলাদের থাকার নিয়ম নেই। যদি সত্যি সত্যি শামারোখ অসুস্থ হয়ে পড়ে, আমি কি করে তাকে চলে যেতে বলব! নানারকম চিন্তা আমার মনে আনাগোনা করছিল। মানুষ তো খারাপটাই চিন্তা করে আগে। এক সময় শামারোখ কথা বলল, তার গলার স্বরটা অত্যন্ত ক্ষীণ এবং ফাসফেঁসে শোনালো। মনে হলো, সে যেন স্বপ্নের মধ্যেই কথা বলছে, হাফিজ ভাই, আমার খুব তেষ্টা পেয়েছে। আমি বললাম পানি খাবেন? সে বলল, আপনার যদি কষ্ট না হয়, আমাকে এক কাপ চা করে খাওয়ান। আমি চায়ের কেতলি হিটারে বসিয়ে বললাম, আপনি মুখ-হাত ধুয়ে তৈরি হয়ে নিন। আমার কথায় সে উঠে বসল এবং বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এল। আমি চায়ের পেয়ালাটা তার হাতে তুলে দিলাম। প্রথম চুমুক দিয়েই সে বলল, জাহিদ ভাই, আজ রাতটা আপনার ঘরেই কাটিয়ে দেব। তার কথা শুনে আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। তাকে ঘরের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি হন্যে হয়ে উঠেছি আর এখন মহিলা বলে কিনা আজ রাতটা আপনার ঘরে থেকে যাব। আমাকে বলতেই হলো, আমাদের এটা পুরুষ হোস্টেল, ভদ্রমহিলাদের তো থাকার নিয়ম নেই। শামায়োখ বলল, অনেক মহিলা তো থাকেন দেখলাম। আমি বললাম, তারা বোর্ডারদের কারো-না-কারো স্ত্রী। শামারোখ বলল, তাতে কি হয়েছে! আমিও তো আপনাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি। বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়া আর বিবাহিতা স্ত্রী হিসেবে সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন করে এক ছাদের তলায় থাকা এক জিনিস নয়। ব্যাপারটা আমি শামারোখকে বোঝাবো কেমন করে? শামারোখ চায়ের কাপটা টেবিলের ওপর রেখে বলল, আমার প্রস্তাবটা আপনার পছন্দ হলো না, তাই না? তাহলে তো চলেই যেতে হয়। ঝোলাটা কাঁধে নিয়ে সে তক্ষুনি পা বাড়ালো । আমি হাত ধরে তাকে বসিয়ে দিয়ে বললাম, কথাটা এভাবে বলছেন কেন? আপনি প্রস্তাবটা করে আমাকে সম্মানিত করেছেন। কিন্তু তার আগে কতগুলো কথা তো চিন্তা করে দেখতে হবে। সে বলল, আপনি কি মনে করেন, আমি চিন্তা না করেই কথাটা আপনাকে বলেছি। আমি বললাম, সেটা বলাও আমার উদ্দেশ্য নয়। মানসিকভাবে আজ আপনি খুব অস্থির এবং বিপর্যস্ত। জ্বরের তাপ যখন বেশি থাকে, গরম পানি পান করতে নেই। আপনি এই অবস্থাটা কাটিয়ে উঠে ভেবে-চিন্তে যদি আবার আমার কাছে বলেন, সবকিছু জেনেও আমাকে বিয়ে করতে চান, আমি মনে করব, আমার হাতে স্বর্গ চলে এসেছে।