কলকাতা থেকে ফিরে একদিন সন্ধ্যায় আমি আর্ট ইন্সটিটিউটে দুরদানার খোঁজ করতে গিয়েছিলাম। দেখা হয়নি। সেদিন দুরদানা ইন্সস্টিটিউটে আসে নি। আমি একজন ছাত্রকে চিনতাম। তার কাছে আমি একটা চিরকুট রেখে এসেছিলাম। কলকাতার স্মৃতিকণার কথা উল্লেখ করে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই, একথা লিখে চলে গিয়েছিলাম। তারপরের দিনের কথা বলি। শরিফ মিয়ার ক্যান্টিনে দুপুরবেলা খেতে গিয়েছি। ক্যান্টিনে বিশেষ ভিড় ছিল না। হুমায়ুন একটা টেবিলের সামনে ঝুঁকে পড়ে ডায়েরি থেকে কবিতা কপি করছে। আমি তার পাশে গিয়ে বসতেই সে ডায়েরি থেকে মুখ না তুলেই বলল, জাহিদ ভাই, চিৎকার করবেন না, চুপচাপ খেয়ে চলে যাবেন। আমার কবিতার মাত্রা গড়বড় হয়ে যাচ্ছে। মেলাতে পারছি না। আপনি চেল্লাতে থাকলে লেখার কাজ খতম।
আমি হুমায়ুনের টেবিল থেকে উঠে এসে আরেকটা টেবিলে বসেছিলাম। তখনই চক্কর-বক্কর শার্টপরা ভদ্রমহিলাকে আমার নজরে পড়ে। ভদ্রমহিলার শার্টটা প্যান্টের ভেতর ঢোকানো । ছেলেদের মতো করে মাথার চুল ছাঁটা। গলায় মেশিনগানের গুলির খোসা দিয়ে তৈরি একখানা হার। দূর থেকে দেখলে মনে হবে ভদ্রমহিলা গলায় একটা ছোটখাটো খড়গ ঝুলিয়ে রেখেছেন। এই হারটা না থাকলে তাকে আমি ছেলেই মনে করতাম। তাকে ওই বেশভূষায় দেখে আমার চোখে একটা ধাক্কা লাগল। মনে মনে চটে উঠলাম। ভদ্রমহিলা সহজে দৃষ্টি অকর্ষণ করার জন্য গলায় আস্ত মুক্তিযুদ্ধ ঝুলিয়ে রেখেছেন। তাকে ঘিরে বসে রয়েছে চারজন যুবক। এই অভিনব ফ্যাশনের স্তাবকও জুটে গেছে। যুদ্ধের রকমারি সব উপসর্গ তাতে তরুণ তরুণীদের মধ্যে নানাভাবে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। তবে আজ যে জিনিস দেখলাম, তখন রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার যোগাড়। একটা নীরব প্রতিবাদ আমার ভেতরে জন্ম নিচ্ছিল। আমি কাউকে কিছু না বলে শরীফ মিয়াকে খাওয়ার বিল মিটিয়ে দিয়ে মাঠে এসে বসলাম। মনে মনে বললাম, বেশ করেছি। মহিলাকে বুঝিয়ে দিতে পেরেছি, যত উগ্রভাবে তিনি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করেন, মানুষও তত বিরক্ত হয়ে তাকে পরিহার করতে পারে ।
আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে থাকতাম। সেদিন রাতে যখন ফিরলাম বুড়ো দারোয়ান হাফিজ জানালো, ছার, আপনের লগে দেখা করনের লাইগ্যা দরদান সাব বইলা একজন আইছিল। আমি কইছি কাউলকা ছকালে আটটা নটার সমে আইলে ছারের লগে দেহা অইব। হাফিজের বাড়ি ঢাকায়। ঢাকাইয়া ভাষা টানটোন আর মোচড়সহ উচ্চারণ করে সে একটা নির্মল আনন্দ পেয়ে থাকে। চিকন-চাকন মানুষটা ভাঙা ভাঙা গলায় যখন ঢাকাইয়া বুলি ঝেড়ে দেয়, তখন হাফিজের মধ্যে একটা ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। যা হোক আমি দুরদান বলে কোনো লোককে চিনিনে।
তারপরের দিন সকালবেলা ডাইনিং হলে নাস্তা করছি, এই সময় হাফিজ এসে বলল, ছার কাউলকার হেই ছাব আইছে। আমার চা খাওয়া শেষ হয়ে এসেছিল। আমি বললাম, হাফিজ একটু অপেক্ষা করতে বললো, আমি আসছি। নাস্তার বিল মিটিয়ে হল গেটে এসে দেখি, গতকাল শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে যাকে দেখেছিলাম, সেই মহিলা। শুধু গলায় বুলেটের হারটি নেই। হাফিজ চোখে ঝাঁপসা দেখে। আমি বললাম, হাফিজ তুমি চোখে ভাল দেখতে পাও না। ইনি ছেলে নন, মেয়ে। হাফিজ ভাল করে চোখ ঘষে ভদ্রমহিলার দিকে তাকায়। তারপর বলল, হায় হায় ছাব আমারেতো মুশকিলে ফালাইয়া দিলেন, ভিতরেতো মাইয়া মাইনসের যাওনের অর্ডার নাই।
ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে কি কারণে মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ কাহিনীটা আমি শুনেছি। একজন শিক্ষক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার স্ত্রী এবং ছেলে-মেয়েদের অসহায়ত্বের কথা চিন্তা করে তার বেগমকে ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলের ওয়ার্ডেনের কাজটি দিয়েছিল। ভদ্রমহিলাকে তার আসল বয়সের তুলনায় তরুণী মনে হতো এবং চেহারায় একটা আগলা চটক ছিল। নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েই তিনি একই সঙ্গে দুজন বিদেশী ছাত্রকে ঘায়েল করে ফেলেছিলেন। একজন মালয়েশিয়ান, আরেকজন প্যালেস্টাইনের। তার চমৎকার ক্রীড়াটি অনেকদিন পর্যন্ত সুন্দরভাবে চালিয়ে আসছিলেন। কিন্তু একদিন গোল বাঁধল। প্যালেস্টাইনের ছাত্রটি এক বিকেলবেলা অফিসের ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখে মালয়েশিয়ান ছাত্রটি ওয়ার্ডেনকে চুমো খাচ্ছে। এই দৃশ্য দর্শন করার পর তার রক্ত চড়চড় করে উজানে বইতে আরম্ভ করল। সে রুমে গিয়ে ছুরি নিয়ে এসে মালয়েশিয়ানটির ওপর চড়াও হলো। আঘাতের লক্ষ্য ছিল বুক, কিন্তু মালয়েশিয়ানটি সরে যাওয়ায় লেগেছিল কাঁধে। তারপর থেকে হোস্টেলে কোনো মহিলা আসা নিষেধ।
গল্পটি আমরা জানতাম। হোস্টেল তৈরি হওয়ার পর থেকে যত মজার ঘটনা ঘটেছে, তার কোনো লিখিত ইতিহাস না থাকলেও, তিন মাস বসবাস করলে সেসব না জানার উপায় থাকে না। বহুকাল আগের একটা নিয়ম আমার বেলায় এমনভাবে কার্যকর হতে দেখে আমি প্রথমত অপ্রস্তুত বোধ করলাম। দ্বিতীয়ত চটে গেলাম। অপ্রস্তুত বোধ করলাম এ কারণে যে, একজন ভদ্রমহিলার কাছে আমার মান-ইজ্জত খোয়া যাচ্ছে। তাকে আমি ঘরে নিয়ে যেতে পারছিনে। আরো চটলাম এ কারণে, এই বুড়ো মূর্খ দারোয়ান একটা বিষয় হিসেবের মধ্যে আনছে না, আমি সদ্য যুদ্ধফেরত একজন মুক্তিযোদ্ধা। সব জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধে আলাদা। আইনে যা থাকুক আমি একজন ভদ্রমহিলাকে আমার ঘরে নিয়ে যেতে পারব না, তা কেমন করে হয়! কোনো রকমের অপ্রিয় বিতণ্ডা যাতে সৃষ্টি না হয়, সেজন্য দারোয়ানকে বললাম, ঠিক আছে হাফিজ, ভদ্রমহিলা অনেক দূর থেকে এসেছেন, একবার ভেতরে ঢুকতে দাও। তবু তার গোঁ ভাঙল না, না ছাব কানুন ভাঙা যাইব না, ওয়ার্ডেন ছাব আইলেও আওরত নিয়া ভিতরে যাইবার পারব না। ভাইস চ্যান্সেলর ছাব ভি না । আমি দেখলাম ওই ঠ্যাটা লোকটার সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। আমি বললাম, তুমি ওয়ার্ডেন, ভাইস চ্যান্সেলর যার কাছে ইচ্ছে নালিশ করো গিয়ে, আমি গেস্ট নিয়ে ভেতরে গেলাম। সে বলল, না ছাব সেটাওভি অইবার পারব না। ভদ্রমহিলা যাতে ভেতরে ঢুকতে না পারেন, সেজন্য গেটে ঢোকার পথে দুহাত বাড়িয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি ভীষণ ক্ষেপে উঠছিলাম, কিন্তু কি করব, সেটা ঠিক করতে পারছিলাম না।