সামনের দরজা বন্ধ করে আমি পেছনের দরজাটা খুলে দিলাম। ঠিক এই সময় আমার কি করা উচিত স্থির করতে না পেরে সিগারেট জ্বালালাম। একটা কি দুটো টান দিয়েছি, এরই মধ্যে দেখি শামারোখ ফুলে ফুলে কেঁদে উঠছে। কান্নার তোড়ে তার শরীরটা বেঁকে বেঁকে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সিগারেট টানা যায় না। আমি সিগারেটটা ছুঁড়ে দিলাম। চেয়ারটা বিছানার কাছে নিয়ে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে শামারোখ, কাঁদছেন কেন? কান্নার বেগ একটু কমে এলে সে বলল, জাহিদ ভাই আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। তারপরে আবার কাঁদতে আরম্ভ করল । আমি কিছুক্ষণ তার বিছানার পাশে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। একজন মহিলা আমারই পাশে বিছানায় কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে, অথচ আমি করার মতো কিছুই খুঁজে পাচ্ছি নে। এক সময়ে বাথরুমে গিয়ে তোয়ালে এনে তার মুখ মুছিয়ে দিলাম। এই কাজটা করতে গিয়ে আমার হাত কেঁপে গেল, শরীর কেঁপে গেল, কথা বলতে গিয়ে দেখি আমার কণ্ঠস্বরও কাঁপল। আগে শামারোখের শরীরের কোনো অংশ আমি এমনভাবে স্পর্শ করি নি। আমি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, শামায়োখ, বলুন, আপনি কাঁদছেন কেন? আমি চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম। এলোমেলো হয়ে যাওয়া শাড়িটা এখানে-ওখানে টেনেটুনে ঠিক করে দিলাম।
শামারোখ আমাকে বলল, জাহিদ ভাই, আপনার চেয়ারটা টেনে একটু কাছে এসে বসুন। আমি চেয়ারটা খাটের একেবারে কাছে নিয়ে গিয়ে তার হাতটা তুলে নিলাম, কোমল স্বরে বললাম, বলুন শামায়োখ আপনার কি হয়েছে? সে বলল, জাহিদ ভাই, আমার সর্বনাশ হয়েছে। আমি মরে গেলেই সবচাইতে ভাল হতো। তারপর আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। আমার ইচ্ছে হয়েছিল, তার মুখে চুমু দিয়ে বসি। কিন্তু পারলাম না। হয়তো আমার সাহস নেই । অথবা বিপদে-পড়া মহিলার ওপর কোনো সুযোগ গ্রহণ করতে আমার মন সায় দেয় নি। শামায়োখের হাতটা ধরে আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। আর শামারোখ অবিরাম কেঁদে যাচ্ছে। আমি যদি চিত্রকর হতাম এই রোরুদ্যমান রমণীর একটা ছবি আঁকতাম । ক্রন্দনরত অবস্থায় শামায়োখের শরীর থেকে এক বিশেষ ধরনের সৌন্দর্য ফুটে বেরিয়ে আসছিল। তার শরীরে বয়সের ছাপ পড়েছে। তার স্তন জোড়া ঈষৎ হেলে পড়েছে। চুলের মধ্যে অনেকগুলো রূপোলি রেখা দেখতে পাচ্ছি। তারপরও শামায়োখ এখনো কী অপরূপ সুন্দরী। দুধে-আলতায় মেশালে যে রকম হয়, তার গায়ের রঙ অবিকল সেরকম। উরু দুটো সুডৌল। পা দুটো একেবারে ছোট। গোড়ালির ফর্সা অংশটাতে জানলার ফুটো দিয়ে একটা তেরছা আলোর রেখা এসে পড়েছে। বার বার তাকিয়েও আমি চোখ ফেরাতে পারছি নে। বাম হাতটা বাঁকা করে বিছানায় এলিয়ে রেখেছে। কান্নার তোড়ে ঈষৎ হেলে-পড়া স্তন দুটো কেঁপে কেঁপে উঠছে। মনে মনে আমি আল্লাহকে ধন্যবাদ দিলাম। অর্ধ আবৃত এমন সুন্দরী একটা নারীর শরীর এত কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছি। বালিশের দুপাশে তার চুলগুলো ছড়িয়ে রয়েছে। সমুদ্রের অতল থেকে দেবী ভেনাসের আবির্ভাবের যে ছবি শিল্পী এঁকেছেন, শামারোখকে কিছুটা সেরকম দেখাচ্ছে। তার নাক-মুখ-চিবুক সবকিছু যেন দেবী ভেনাসের শরীরের অংশ। আমি এই রকম শরীরের কোনো নারী জীবনে দেখি নি। শামারোখ যদি সুস্থ শরীরে সচেতনভাবে নারীর সমস্ত স্বাভাবিক লজ্জা নিয়ে শুয়ে থাকত, তার এরকম অপরূপ সৌন্দর্য প্রকাশমান হয়ে উঠত না। সে কেঁদে যাচ্ছে, কান্নার তোড়ে তোড়ে শরীর থেকে একরকম করুণ দুঃখ জাগানিয়া সৌন্দর্য ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। তার ডান হাতটা হাতে নিয়ে আমি অনেকক্ষণ অভিভূতের মতো বসে রইলাম।
একসময় তার কান্না বন্ধ হলো। সে উঠে বসল। আমাকে বলল, আরো এক গ্লাস পানি দিন। আমি গ্লাসটা হাতে দিলে আস্তে আস্তে পানিটা খেয়ে নিল। তারপর তোয়ালেটা নিয়ে বাথরুমে গেল। অনেকক্ষণ সে বাথরুমে কাটালো। যখন বেরিয়ে এল তাকে অনেকখানি সুস্থির দেখাচ্ছিল। ভাল করে হাত-মুখ ধুয়েছে। মাথায়ও পানি দিয়েছে। চুলের উস্কখুস্কু ভাবটি এখন নেই। আমাকে বলল, আপনার তোয়ালেটা মোটা। এ-দিয়ে চুলের পানি বের করা যায় না। গামছা থাকলে দিন। ভাগ্যিস আমার একটা গামছা ছিল। সেটা তাকে দিলাম। চুলের সঙ্গে গামছাটা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পাক দিয়ে দিয়ে সমস্ত পানি বের করে আনল। তারপর আমার ক্রিমের কৌটো নিয়ে আঙুলে একটুখানি ক্রিম বের করে আলতো করে মুখে লাগালো। এই সবকিছু করার পর সে আবার গিয়ে চেয়ারের ওপর বসল। এসব কিছুই যেন সে ঘোরের মধ্যে করে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। এই পীড়াদায়ক নীরবতা আমার স্নায়ু-শিরায় চাপ প্রয়োগ করছিল। আর চুপ করে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো।
একটু আগে তার হাতখানা হাতে নিয়ে আদর করেছি। দুহাতে তার চোখের জল মুছিয়ে দিয়েছি। এই গম্ভীর রূপ দেখে আমি তার শরীর স্পর্শ করার সাহসও হারিয়ে ফেললাম। নরম জবানেই বললাম, আপনার দুঃখের কথাটা জানাতে যদি আপত্তি না থাকে আমাকে বলতে পারেন। আমি তো আপনার বন্ধু । আমাকে দিয়ে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না। পারলে আপনার উপকারই করব। আমার কথা শুনে শামায়োখের চোখ জোড়া ঝিকিয়ে উঠল। আপাদমস্তক আমার শরীরে তার দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। তারপর সহসা দাঁড়িয়ে গেল, আবার সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ল। আঙুলে চুলের একটা গোছা জড়াতে জড়াতে বলল, আপনি আমার উপকার করতে চান? তার কণ্ঠস্বরটা একটু অস্বাভাবিক শোনালো। আমি দৃঢ়স্বরে বললাম, যদি আমার সাধ্যের মধ্যে থাকে, অবশ্যই আপনার উপকার করব। শামারোখ অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল, তাহলে আপনি আমাকে বিয়ে করুন। এ কী বলছে শামায়োখ, তার কাছ থেকে এ কী শুনলাম! ঘরের মধ্যে বাজ পড়লেও আমি এতটা আশ্চর্যান্বিত হতাম না।