সোহিনী, প্রেমও তো এক ধরনের নির্বাণ। আমি নিতান্তই সামান্য মানুষ । গৌতমের উচ্চতায় নিজেকে স্থাপন করব, এমন ধৃষ্টতা আমার মতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ জীবের কেমন করে হবে! তারপরও আমি সাহস করে বলব, আমার চেতনায় প্রেমের কুঁড়ি ফুটি ফুটি করছে। এই প্রেমের শক্তিতেই এমন শক্তিমান হয়ে উঠেছি, মাঝে মাঝে নিজেকে তরুণ দেবতার মতো মনে হয়। আমার অতীতের দিকে আমি সাহস করে তাকাতে পারি। তার অক্টোপাস-বন্ধন ছিন্ন করে নিজেকে অনন্তের অভিমুখে ছুটিয়ে নিতে পারি। সোহিনী, তুমি ভাল করেই জানো আমার কোনো ধন-সম্পদ নেই। মা-বাবা-আত্মীয়-স্বজন, স্ত্রী-পুত্র-পরিবার আমার কিছুই নেই। যে সজীব বন্ধন একজন মানুষকে নানা কিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত করে রাখে, আমার ভাগ্য এমন ফর্সা যে সেসব কিছুই আমার জোটেনি। অতীত দিনের অর্জন বলতে আমার জীবনে যেসব নারী এসেছিল, যারা আমাকে কাঁদিয়েছে, হাসিয়েছে, দাগা দিয়েছে, যারা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, সেই দুঃখ-সুখের স্মৃতি চক্রটুকুই শুধু আমার একমাত্র অর্জন। এতকাল স্মৃতি নিয়েই বেঁচে ছিলাম। তোমার স্পর্শে আমার সমগ্র সত্তা জেগে উঠেছে। কাদায়-আটকানো হাতি যেমন ডাঙায় ওঠার জন্যে সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করে, আমিও সেরকম স্মৃতির জলাভূমি থেকে ছুটে বেরিয়ে আসার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি প্রাণপণ।
কাজটা সহজ নয়, সোহিনী। একজন মানুষের শরীরের একটা হাত কিংবা পা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে অবশ হয়ে গেলে মানুষ যেমন স্বেচ্ছায় আপন হাতে সে অঙ্গটি কেটে বাদ দিতে পারে না, সে রকমই অতীতকে বর্তমানে টেনে তুলে তার জীর্ণ অংশ হেঁটে ফেলাও একরকম অসম্ভব। দিব্য চেতনা অর্জন না করলে কেউ তা পারে না। আমি মনে করছি আমার হৃদয়ে প্রেম জন্ম নিয়েছে। অমৃতলোকের হাওয়া। আমার মনে তরঙ্গ জাগিয়ে তুলছে, তীব্রভাবে অনুভব করছি, আমি অমৃতলোকের যাত্রী। আমার যাত্রাপথ যদি অবারিত করতে চাই, আমার জীবনে যেসব নারী এসেছিল, চলে গিয়েছে, স্মৃতির গভীরে খনন করে তাদের লাশগুলো আমাকে বের করে আনতে হবে। স্মৃতিকে যদি অতীতমুক্ত না করি, বর্তমানকে ধারণ করব কোথায়? সোহিনী, আমি জানি, আমার অনেক অশ্রু ঝরবে, বুকের ভেতর তপ্ত শোণিতের ধারা বইবে। কিন্তু উপায় কি? এই এতগুলো নারীর স্মৃতি-ভার বুকে নিয়ে আমি তোমার দিকে অগ্রসর হবো কেমন করে? আমি যদি নির্ধারতা অর্জন না করি, সামনে চলব কেমন করে? তাই স্মৃতির ভাঁড়ার উন্মোচন করে এইসব নারীকে অস্তিত্বহীন করে ফেলতে চাই। তারা ভাল ছিল কি মন্দ ছিল, সে বিচারে আমার কাজ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, তারা আমার জীবনে এসেছিল। একেকজন একেক ধরনের বন্ধনে আমার চেতনালোক আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এখন আমি সেই বন্ধনের গিঁটগুলো খুলে ফেলতে উদ্যত হয়েছি। মনে হয়, হাতুড়ি দিয়ে পাঁজরে আঘাত হানছি। সমস্ত জীবনের অর্জিত গহন সম্পদ তছনছ করে ফেলতে যাচ্ছি। কী করব! প্রেমপন্থের যাত্রী আমি। স্মৃতির কবর না খুঁড়লে তো আমার যাওয়া হবে না। সবকিছু ঝেড়ে ফেলে দিয়ে কেবল আমার আমিত্বটুকু নিয়েই তোমাকে অনুসরণ করতে চাই।
.
০৩.
প্রিয় সোহিনী, আমি তোমার কাছে দুরদানার কথা বয়ান করব। তার পুরো নাম দুরদানা আফরাসিয়াব। কেমন ফার্সি কিংবা তুর্কি মনে হয় না! লোকে বলত দুর্দান্ত থান্ডার। দুরদানার সঙ্গে থান্ডার শব্দটি বেশ মানিয়ে গিয়েছিল। কেউ কেউ তাকে দুর্দান্ত চক্রযান বলেও ডাকত। কারণ নাখালপাড়ার দিক থেকে দ্রুতবেগে সাইকেল চালিয়ে সে আর্ট ইনস্টিটিউটে আসত। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে একটি উনিশ বছরের তরুণী ঢাকার রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে কলেজে আসছে-যাচ্ছে, ব্যাপারটা কল্পনা করে দেখো। দুপাশের মানুষ হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখত। খাইবার মেল ছবিতে পাঞ্জাবি হিরোইন নীলুর লড়াকুপনা দেখে তৃতীয় শ্রেণীর দর্শকেরা যেমন শিস্ দিত, অশ্লীল মন্তব্য ছুঁড়ে দিত, তেমনি সাইকেল চালানোরত দুরদানাকে দেখেও রাস্তার লোকেরা তাদের অবদমিত অনুভূতি অশালীন ভাষায় প্রকাশ করতে থাকত। ছেমরির বুক-পাছা-নিতম্ব এসব নিয়ে সরস আলোচনার ঝড় বয়ে যেত। পাঞ্জাবি হিরোইন নীলুর কাজ-কারবার পর্দায় সীমিত ছিল। আর গোটা উন্মুক্ত রাজপথটাই ছিল দুরদানার চলন ক্ষেত্র। রাজহাঁস যেমন পাখা থেকে পানি ঝেড়ে ফেলে, তেমনি দুরদানাও লোকজনের কোনো মন্তব্য গায়ে মাখত না। স্কুলগামী ছোট ঘোট বাচ্চারা হাততালি দিয়ে সাইকেল চালানোরত দুরদানাকে অভিনন্দন জানাতো। দুরদানা খুশি হয়ে হ্যান্ডেল থেকে দুহাত উঠিয়ে নিয়ে শুধু পায়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে বাচ্চাদের তাক লাগিয়ে দিত। প্রিয় সোহিনী, আজ থেকে তিরিশ বছর আগে ঢাকার রাস্তায় এত ভিড় ছিল না। অনায়াসে দুরদানা স্কুলের বাচ্চাদের সাইকেলের খেলা দেখাতে পারত।
এই দুরদানার কথা আমি প্রথম শুনেছিলাম কলকাতায়। স্মৃতিকণা চৌধুরীর কাছে। উনিশশ’ একাতুর সালে। তখন তো মুক্তিযুদ্ধ চলছিল। আমরা কলকাতায় পালিয়েছিলাম। তখন স্মৃতিকণা চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয়। উপলক্ষ বাংলা সাহিত্য। স্মৃতিকণা আমার কাছে দুরদানার কথা জানতে চেয়েছিল। আমি চিনি না বলায় অবাক হয়ে গিয়েছিল- ঢাকায় থাকি অথচ দুরদানাকে চিনিনে। এ কেমন করে সম্ভব! প্রথম স্মৃতিকণার কাছেই শুনেছিলাম দুরদানা কি রকম ডাকসাইটে মেয়ে। সে সাইকেল চালিয়ে কলেজে আসে। ছেলেদের সঙ্গে মারামারি করতেও তার বাধে না। প্রয়োজনে ছোরাছুরি চালাতেও পারে। স্মৃতিকণার কাছে শুনে শুনে দুরদানার একটা ভাবমূর্তি আমার মনে জন্ম নিয়েছিল। মনে মনে স্থির করে ফেলেছিলাম এই যুদ্ধ যদি শেষ হয়, ঢাকায় গিয়ে দুরদানার তত্ত্বতালাশ করব।