‘ষষ্ঠ দিন শ্রম অন্তে প্রভু,
অপূর্ব বিস্ময় ভরে করে উচ্চারণ
পরবর্তী সৃষ্টি হবে দিব্যি অনুপম।
তখনই ডাগর আঁখি মেলেছে নন্দিনী
মরি, মরি দৃষ্টি হেরি,
আপন অন্তর তলে বিধাতাও
উঠেছে শিহরি।’
সেই সৌন্দর্য দেখার পর স্বয়ং স্রষ্টা মহাশয়কেও নিজের হৃদয়-গভীরে শিউরে উঠতে হয়। সেই একই স্বর্গজাত সৌন্দর্যের প্রতি তাজিমের নিদর্শনস্বরূপ শামারোধের নামের সঙ্গে কন্যা শব্দটি যোগ করলাম। প্রিয় সোহিনী, এই ‘কন্যা’ শব্দটি যুক্ত করে আমি মস্ত বিপাকে পড়ে গেলাম। তুমি প্রশ্ন করবে, যে মহিলা স্বামী-পুত্র ছেড়ে বেরিয়ে আসে, যেখানে-সেখানে হৃদয়ের অগ্ন্যুৎপাত ঘটায়, তার কন্যাত্ব বহাল থাকে কেমন করে? আমি তর্ক করার মানুষ নই। তবু প্যাচালো বিতর্কে যাতে জড়িয়ে পড়তে না হয়, তাই সময় থাকতে বলে রাখতে চাই, কোনো কোনো নারী আছে যারা সবসময় কন্যাত্ব রক্ষা করে চলতে পারে। সন্তান জন্ম দিলে বা পুরুষ বদলালে তাদের কন্যা-জীবনের অবসান ঘটে না। প্রিয় সোহিনী, আমি ধরে নিচ্ছি, শামারোখ সম্বন্ধে তোমার মনে একটি সহানুভূতির ভাব সৃষ্টি হয়েছে, সুতরাং আমি নির্বিবাদে তার কাহিনীটা তোমার কাছে প্রকাশ করতে পারি। সুন্দরের প্রতি সহানুভূতি জিনিসটার একটা খারাপ দিক আছে। ইচ্ছে করলেও তাকে খারাপভাবে আঁকা সম্ভব হয় না। তাই, শামারোখ আসলে যা ছিল, আর আমি যা বয়ান করছি, তার মধ্যে একটা হেরফের থেকেই যাচ্ছে।
কন্যা শামারোধের সঙ্গে কিভাবে পরিচয় ঘটল, সে ঘটনাটি আমি তোমার কাছে তুলে ধরতে চাই। ঘটনা বললে সুবিচার করা হবে না। পেছনে একটা ইতিহাস আছে। সেটা বিবৃত করছি। একদিন বিকেলবেলা হোস্টেলে ঘুম থেকে উঠে স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। ঘুমের মধ্যে আমি মাকে স্বপ্নে দেখলাম। তিন মাস আগে মা মারা গেছেন। আমি তার একমাত্র ছেলে। মায়ের মৃত্যুর সময় আমি কাছে ছিলাম না । মৃত্যুর পর এই প্রথমবার তাকে স্বপ্নে দেখলাম। পুরো স্বপ্নটা অস্পষ্ট এবং ঝাঁপসা। বারবার একাগ্র মনোযোগে স্বপ্নটা জীবিত করার চেষ্টা করছি। এই সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খুলে দেখি ইংরেজি বিভাগের পিয়ন বাটুল। এই লম্বা লিকলিকে চেহারার তরুণটির নাম বাটুল কেন, আমি বলতে পারব না। যাহোক, সে আমাকে সালাম করার পর জানালো বিভাগের চেয়ারম্যান ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরী আমাকে সালাম দিয়েছেন। অতএব, আমাকে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে আর্টস বিল্ডিংয়ের দোতলায় সালামের তত্ত্ব নিতে ছুটতে হলো।
আমি দরজা ঠেলে বিভাগীয় চেয়ারম্যান ড. শরিফুল ইসলামের অফিস ঘরে প্রবেশ করলাম। কারেন্ট নেই, পাখা চলছে না। বেশ গরম। ড. চৌধুরী জামার বোতাম খুলে ফেলেছেন। তার বুকের লম্বা লম্বা লোমলো দেখা যাচ্ছে। বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপর ছড়ানো বই-পুস্তক। তিনি কিছু একটা লিখছিলেন। আমাকে দেখে হেসে উঠতে চেষ্টা করলেন। ড. চৌধুরীকে হাসতে দেখলে আমার একটা কথা মনে হয়। ভদ্রলোক ওই হাসিটা যেন দোকান থেকে কিনে এনেছেন। এমনিতে কৃষ্ণকান্তি, যখন গাম্ভীর্য অবলম্বন করেন, বেশ মানিয়ে যায়। কিন্তু তিনি যখন বড় দাঁতগুলো দেখিয়ে এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দ তুলে হেসে ওঠেন, সেটাই। আমার কাছে ভয়ংকর বিদঘুঁটে মনে হয়।
আমার ভাগ্য ভাল বলতে হবে। হাসিটা অল্পের মধ্যেই তার প্রসারিত মুখগহ্বরের ভেতর কোথাও উধাও হয়ে গেল। তিনি একটু তোয়াজ করেই বললেন, বসো জাহিদ। পকেটে সিগারেট থাকলে খেতে পার। কোনোরকম সংকোচ করার প্রয়োজন নেই। আমি বাটুলকে চা আনতে বলেছি। আর পাঁচ-ছটা লাইন লিখলেই হাতের লেখাটা শেষ হয়ে যাবে।
আমি সিগারেট ধরালাম। তিনি লেখা শেষ করছেন। এরই মধ্যে বাটুল চা দিয়ে গেল। হাতের লেখা কাগজের স্লিপগুলো পিন দিয়ে গেঁথে একটা ফাইলের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলেন। ততক্ষণে পাখা চলতে আরম্ভ করেছে। তিনি গ্লাস থেকে পানি খেয়ে মন্তব্য করলেন, বাঁচা গেল। আজ সারাদিন যা গরম পড়েছে। তারপর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, তোমার চেয়ারটা একটু এদিকে নিয়ে এসো। আমি চেয়ারটা তার মুখোমুখি নিয়ে গেলাম। চা খাওয়া শেষ হলে তিনি জামার খুঁটে চশমার কাঁচ দুটো মুছে আমার দিকে ভাল করে তাকালেন। তারপর বললেন, তোমাকে একটা দুঃখের কথা বলতে ডেকে এনেছি। আমার শরীরে একটা আনন্দের লহরি খেলে গেল। তাহলে তিনি আমাকে তার ব্যক্তিগত দুঃখের কথা বলার উপযুক্ত মানুষ ধরে নিয়েছেন। নিজের কাছেই আমার মূল্য অনেকখানি বেড়ে গেল। কোনো সুন্দরী মহিলা যদি বলতেন, আমি তোমাকে ভালোবাসি, অতখানি খুশি হয়ে উঠতাম কি না সন্দেহ। ড. চৌধুরীর বুকের ভেতরে নিবিড় যত্নে পুষে রাখা দুঃখের কথাটা শোনার জন্যে অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে লাগলাম।
বাটুলকে ডেকে চায়ের খালি কাপ এবং গ্লাস নিয়ে যেতে বললেন। তারপর আমার দিকে তাকালেন, শোনো, তোমার গুরু আবুল হাসানাত সাহেবকে থামাও। তিনি আমাদের ডিপার্টমেন্টকে নষ্ট করে ফেলার জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছেন। তার কথা শুনে আমি তো সাত হাত জলে পড়ে গেলাম। আবুল হাসানাত বুড়ো মানুষ। বেশ কিছুদিন আগে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে রিটায়ার্ড করেছেন। চিরকুমার। রান্নাবান্না, বাজার, দাবা এবং বই নিয়ে সময় কাটান। কারো সাতে-পাঁচে থাকেন না, তিনি কী করে ইংরেজি ডিপার্টমেন্টকে নষ্ট করবেন। ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরীর অভিযোগটা আমার কাছে হেঁয়ালির মতো শোনালো। সত্যি সত্যিই বলছি, এরকম একটা কথা তার মুখ থেকে শুনব, তার জন্যে আমি প্রস্তুত ছিলাম না। ড. চৌধুরীর কথার মধ্যে উত্তাপ ছিল, ঝাঁঝ ছিল। দেখতে পেলাম তার কালো মুখমণ্ডলটা লাল হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে। আমি বুঝতেই পারছিলাম না, তিনি আবুল হাসানাত সাহেবের ওপর অতটা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন কেন? অবশেষে ড চৌধুরী আমার কাছে তার ক্ষোভ-দুঃখ এবং মনোকষ্টের আসল কারণটা খুলে বললেন। এই ঢাকা শহরে বীণা চ্যাটার্জির মতো এক সুন্দরী মহিলা এসেছে এবং এসেই মহিলা আবুল হাসানাত সাহেবের ঘাড়ের ওপর চেপে বসেছে। আবুল হাসানাত সাহেব সেই সন্দেহজনক চরিত্রের মহিলাটিকে ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে চাপিয়ে দিতে চাইছেন। ভাইস চ্যান্সেলর আবুল হাসানাতের আপন মানুষ। চেষ্টা করেও কোনোভাবে ঠেকাতে পারছেন না। যদি একবার এই মহিলা ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পায়, তাহলে ছাত্র-ছাত্রীদের নৈতিক চরিত্র বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।