সারা পথে দুরদানার সঙ্গে আমার একটিও কথা হয়নি। খানে খানানের বাড়ি এসে যখন পৌঁছুলাম, আকাশে নিবিড় করে মেঘ জমেছে। ঘন ঘন বিজলি চমকাচ্ছে। খানে খানান দরজা খুলে দিয়ে খুশিতে একরকম নেচে উঠে বলল, দেখছ তো আসমানের অবস্থা। একটু পরেই বিষ্টি নামবে। আমার কাছে বিসমিল্লাহ খানের মিয়া কি মল্লার এবং মেঘ মল্লার রাগের শানাইয়ের রেকর্ড দুটোই আছে। এখনই শানাই শোনার উপযুক্ত সময়। কাজের লোকটা চা দিয়ে গেল। সে রেকর্ড এবং প্লেয়ার আনতে ভিতরে গেল। আকাশ ভেঙে বর্ষা নেমে এল। খানে খানান প্লেয়ারে রেকর্ড চাপিয়ে দিল। সে বলল, আমরা রেকর্ড শুনতে শুনতে অন্য সবাই এসে পড়বে।
খানে খানান হলো সেই ধরনের মানুষ, নিজেকে অন্যদের কাছে জাহির করে যৌন পুলকের মতো এক ধরনের নিবিড় আনন্দ অনুভব করে। সে বিসমিল্লাহর রেকর্ড কিনেছে নিজের গভীর পিপাসা মেটাবার জন্যে নয়, অন্যেরা বলবে, খানে খানান ছেলেটা বেশ রুচিবান, বিসমিল্লাহর শানাই সে নিয়মিত শোনে- এই জন্যে। খানে খানানের সবকিছুই এ ধরনের। আজ সন্ধ্যেয় দুরদানাকে নিমন্ত্রণ করে আনার মধ্যেও যে এ ধরনের একটা সঁক দেখানোর ব্যাপার আছে, সেটা ক্রমাগত টের পেতে আরম্ভ করেছি। দুরদানা বাংলাদেশে ভীষণ আলোচিত মহিলা। তাকে নিয়ে ফাজিল কলাম লেখকেরা রবিবাসরীয় সংখ্যায় আজেবাজে ফিচার লেখে। কেউ কেউ অবশ্য ভাল কথাও লিখে থাকে। সবকিছু মিলিয়ে দুরদানার একটা ভাবমূর্তি দাঁড়িয়ে গেছে। সেই জিনিসটি খানে খানানের বন্ধু-বান্ধবের কাছে জানান দেয়ার জন্যই আজকের এই আয়োজন। দুরদানাই আজকের নিমন্ত্রণের প্রধান উপলক্ষ। আমি ফাউ ছাড়া কিছু নই। যেহেতু একা নিমন্ত্রণ করলে দুরদানা আসবে না, তাই আমাকেও ডাকা হয়েছে। আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঘরের ভেতর বিসমিল্লাহর শানাইতে মেঘমল্লার বেজে চলেছে। নিসর্গের সঙ্গীত ধারার সঙ্গে বিসমিল্লাহর শানাইয়ের সুর মিলেমিশে কী অপূর্ব মায়ালোকের জাদু রচনা করে যাচ্ছে। আমি দুচোখ বন্ধ করে আছি। সুরের সূক্ষ্ম কারুকাজের প্রতিটি মোচড় আমার ভেতরের গোপন দরজা একটা একটা করে খুলে দিচ্ছে। মুহূর্তেই আমি অপার্থিব জগতের বাসিন্দা হয়ে গেলাম। জগতে এত সুন্দর জিনিস আছে! অকারণে আমার দু’চোখ ঠেলে পানি বেরিয়ে আসতে চাইছে। আহা, কতদিন এমন হৃদয় দ্রাবক বাজনা শুনি নি! খানে খানান দুরদানার সঙ্গে বকর বকর করছে। বিসমিল্লাহ খানের শানাই, আকাশে তুমুল বৃষ্টি আর এদিকে বাড়িতে রান্না হচ্ছে খিচুড়ির সঙ্গে হাঁসের ভুনা মাংস। সবকিছুর এক আশ্চর্য মনিকাঞ্চন সংযোগ। তার বন্ধুবান্ধব যারা আসবে, তাদেরও কেউ ফ্যালনা মানুষ নয়। ধানমণ্ডি থেকে আসবে মনসুর। তার বাবা লয়েড ব্যাংকের জিএম। আর আসছে বনানী থেকে মেহবুব। সে আগামী সপ্তাহে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্যে আচমকা চলে যাচ্ছে। আসবে জুম্মন খাঁ, বাংলাদেশী পপ গানের রাজা। গান গেয়ে জুম্মন শহর-বন্দর মাত করে ফেলেছে। এমনি করে খানে খানান সম্ভাব্য অতিথিদের নাম বলে নিজে উদ্দীপিত হয়ে উঠছিল এবং আমাদেরও তাক লাগিয়ে দিল। এক জায়গায় আটকে গিয়ে ঘ্যার-ঘ্যার আওয়াজ করতে লাগল। পিনটা সঞ্চালিত হচ্ছিল না। আমি খানে খানানকে ডেকে বললাম, দোস্ত, এরকম ঘ্যার-ঘ্যার আওয়াজ আসছে কেন? সে বলল, রেকর্ডারটার এক জায়গায় ফাটা আছে। সেখানটায় আটকে গিয়েছে। দাঁড়াও বদলে দিই।
ঠিক এই সময় আমরা বাইর থেকে দরজা-জানলায় প্রচণ্ড ধাক্কানোর আওয়াজ শুনতে পেলাম। ভেতরের ঘরে বসে আছি। তবু একসঙ্গে অনেক মানুষের গলার আওয়াজ এবং চিৎকার শুনতে পাচ্ছি। এমন বিশ্রী সব গালাগাল করছে, শুনলে কানে আঙুল দিতে হয়। খানে খানান দ্রুত দরজার দিকে উঠে গেল এবং ফাটা রেকর্ডটা সেই একই জায়গায় ক্যার ক্যার শব্দ তুলে ঘুরতে লাগল। না আমি, না দুরদানা- কেউই প্লেয়ারটা বন্ধ করে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না। খানে খানানের সঙ্গে বাইরের লোকজনের তখন উত্তপ্ত বাদানুবাদ চলছে। সব কথা আমাদের কানে আসছে।
কিছুক্ষণ পর খানে খানান ঘরে ঢুকে ফিসফিস করে বলল, দোস্ত, মস্তবড় মুসিবত। ভয়ে তার মুখমণ্ডল ফ্যাকাসে। ঠিকমতো আওয়াজ বের হচ্ছিল না। সে ফিসফিস করে কখনো থেমে, কখনো তুতলিয়ে যা বলল, তার অর্থ দাঁড়ায় এরকম: গত বছর দুরদানা এই পাড়ার পিন্ধু নামের একটা ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পিটিয়েছিল। সেই ছেলেটাই আমার সঙ্গে দুরদানাকে এই বাড়িতে ঢুকতে দেখেছে। টিঙ্কু অনেক লোকজন নিয়ে এসে বাড়ি ঘেরাও করেছে। তারা বলছে, তাদের হাতে দুরদানাকে তুলে দিতে হবে। নইলে দরজা ভেঙে তারা ঘরে ঢুকবে এবং দুরদানাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। সে কাঁপতে কাঁপতে বলল, আমি বলেছি, তোমরা এসেছিলে, কিন্তু চলে গিয়েছ। যদি ঘরে ঢুকে তোমাদের পায়, দুরদানাকে তো নিয়ে যাবেই, আবার ঘরবাড়ি ভেঙেচুরে আস্ত রাখবে না। এখন উপায়?
এটা নতুন নয়। এরকম বহু অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। আমরা দুজন চুপচাপ কাউকে কিছু না বলে পেছন দিককার কিচেনের পাশের দরজাটা খুলে দু বাড়ির সীমানা-দেয়ালের মধ্যবর্তী আধ হাত প্রস্থ সরু পথ ধরে যতটা সম্ভব দ্রুত অগ্রসর হতে থাকলাম। পথটা পার হয়ে বড় রাস্তায় এসে পড়লাম। তুমুল বর্ষার কারণে রাস্তায় মানুষজন ছিল না। সেটা আমাদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। অনেকটা পথ পার হয়ে বলধা গার্ডেনের সামনে এসে যখন একটা খালি রিকশায় উঠে বসলাম, তক্ষুনি ধারণা জন্মালো আমরা এবারের মতো বেঁচে যেতে পেরেছি।