লুলু বলল, আপনাকে আমি খুব ভালভাবে চিনি। আপনার নাম জাহিদ হাসান। আপনি অত্যন্ত নোংরা চরিত্রের মানুষ। আপনাকে চিনতে আমার বাকি আছে! আপনার সঙ্গে মেলামেশা করার পর থেকে দুরদানা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। আপনি তাকে নষ্ট করেছেন। আপনাকে একদিন দেখে নেব। তার কথাবার্তার ধরন দেখে মজা পেয়ে গেলাম। আমি বললাম, না লুলু, দুরদানাকে আমি নষ্ট করি নি। আমাদের সম্পর্ক এখানো পোশাকের বাঁধন অতিক্রম করে নি। লুলু কালির দোয়াতটা উঁচিয়ে ধরে বলল, আমার ইচ্ছে হচ্ছে এটা আপনার মুখে ছুঁড়ে মারি । বুঝলাম, এই মেয়ের সঙ্গে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। মানে মানে এখন বিদেয় করতে পারলেই বাঁচি। আমি বললাম, আপনি সত্যি করে বলুন তো দুরদানা কি আপনাকে বলেছে আমি তাকে নষ্ট করেছি? লুলু টেবিলে থাবা বাজিয়ে বলল, নষ্ট করবার বাকি কি রেখেছেন, এখন দুরদানা আমার সঙ্গে ঘুমোতে চায় না, সে বাড়ি গিয়ে শাড়ি সালোয়ার কামিজ পরতে চায়। এসব তো আপনার কাছ থেকেই শিখেছে। আমি তাজ্জব বনে গেলাম। এ কেমন ধারা নালিশ! বাঙালি মেয়ে মাত্রই তো শাড়ি কিংবা সালোয়ার কামিজ পরে। দুরদানাও যদি পরে, তাহলে অন্যায় কোথায়! দুরদানা শাড়ি পরুক, সালোয়ার কামিজ পরুক সে তার ব্যাপার। লুলু, আমার অপরাধ কোথায়? এবার লুলু চিৎকার করে বলতে আরম্ভ করল, আপনি নিজে মজা মারার জন্য তাকে মেয়ে বানাবার ষড়যন্ত্র করছেন। আমি চাই দুরদানা সব সময়ে পুরুষ মানুষের মতো পোশাক পরবে। মেয়েমানুষের পোশাকে তাকে একবারও দেখতে চাইনে। আপনাকে এক্ষুনি কথা দিতে হবে, আপনি জীবনে কোনোদিন আর দুরদানার সঙ্গে মিশবেন না। দুরদানা সারাজীবন আমার এবং একমাত্র আমার থাকবে। আমাদের পুরুষ মানুষের প্রয়োজন নেই। আমরা দুজনই যথেষ্ট। আপনাকে আমার কথায় রাজি হতে হবে। নইলে এক্ষুনি জোরে চিৎকার দিয়ে লোকজন জড়ো করে জানিয়ে দেব, আপনি আমার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছেন। ভেবে দেখলাম এ মেয়ের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। লুলু যদি সত্যি সত্যি চিৎকার দেয় এবং বলে যে, আমি তার ওপর চড়াও হয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছি, তাই শুনে লোকজন ছুটে আসবে এবং সবাই তার কথা সত্যি বলে মেনে নেবে। আমি আল্লার নাম নিয়ে শপথ করে বললেও কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না। এই আপদ কি করে বিদায় করা যায়, চিন্তা করতে লাগলাম।
অগত্যা আমাকে বলতে হলো, লুলু আপনার কথা আমি মেনে নিলাম। আমি আর কোনোদিন দুরদানার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করব না এবং তার সঙ্গে সম্পর্কও রাখব না। লুলু বলল, মুখের কথায় চলবে না। আপনাকে স্ট্যাম্পে লিখে দিতে হবে। সে সত্যি সত্যি ব্যাগের ভেতর থেকে তিন টাকার স্ট্যাম্প বের করে আনল। আমি তার কথামতো লিখে দিলাম, আমি অমুকের পুত্র জাহিদ হাসান এই মর্মে অঙ্গীকার করিতেছি যে, জীবনে দুরদানা নাম্নী মহিলার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করিব না এবং কোনো প্রকার সম্পর্কও রাখিব না। আমার কাছ থেকে সই আদায় করে কল্পনা আখতার লুলু গমিত হলো। কিন্তু আমি একটা বড় ধাক্কা খেলাম। দুরদানা কি সমকামী?
.
০৭.
মাঝখানে বেশ কিছুদিন আমার সঙ্গে দুরদানার দেখা হয়নি। তার ছোট বোনের শরীর খারাপ যাচ্ছিল। তাই নিয়ে তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। আমি তার বাড়িতে একখানা পোস্টকার্ড লিখে চৌদ্দ তারিখ সন্ধ্যেবেলা উয়ারিতে খানে খানানের বাড়িতে খাওয়ার নিমন্ত্রণের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম। আসলে আমাদের বন্ধুটির নাম আব্দুর রহিম খান। তার দরাজ দিলের পরিচয় পেয়ে খানকে খানেখানান করে নিয়েছিলাম।। আকবরের নওরতনের একজন ছিলেন খানে খানান।
দুরদানা সাড়ে পাঁচটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির। সে সবসময় ঘড়ির নির্দেশ মেনে চলে। যদি পাঁচটায় আসবে বলে, সব সময় লক্ষ্য রাখে সেটা যেন পাঁচটা পাঁচ মিনিটে না গড়ায়। সাইকেলের চাবিটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বলল, জাহিদ ভাই, আজ রাতে সাইকেলটা আপনার এখানে থাকবে। কাল ক্লাস করতে এলে নিয়ে যাব। উয়ারি থেকে আসার পথে আপনি আমাকে বেবি ট্যাক্সিতে নাখালপাড়া অবধি পৌঁছে দেবেন। বেশ কিছুদিন থেকেই আমার মনটা খচ খচ করছিল। দুরদানার সঙ্গে দেখা হয় নি তাই সুযোগ হয় নি জেনে নেয়ার । আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, তুমি কল্পনা আখতার লুলু বলে কোনো মেয়েকে চেন? দুরদানা জবাব দিল, চিনব না কেন! আপনার সঙ্গে তার দেখা হলো কোথায়? বললাম, সে হোস্টেলে এসেছিল এবং অনেক আজেবাজে কথা বলে গিয়েছে। প্রথমে সে অবাক হওয়ার ভঙ্গি করল। তারপর রেগে গেল। পকেট থেকে প্যাকেট বের করে লাইটার জ্বালিয়ে একটা সিগারেট ধরালো। একটা লম্বা টান দিয়ে ধোয়া ছেড়ে বলল, শালীর সাহস তো কম নয়। সে আপনাকে পর্যন্ত বিব্রত করতে ছুটে এসেছে। জানেন জাহিদ ভাই, মেয়েটি আমাকে অস্থির করে তুলেছে। একথা বলতে গিয়ে দুরদানা ফিক করে হেসে ফেলল। আমার যত ছেলে বন্ধু আছে সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে এসেছে, খবরদার, তোমরা দুরদানার সঙ্গে মিশবে না। দুরদানা আমার বর।
দুরদানার সঙ্গে কোনোদিন আমার এ ধরনের কথাবার্তা হয়নি। তার সম্পর্কে আমার মনে যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল, তাতে হাতুড়ির আঘাত লাগছিল এবং একটু একটু করে বার্নিশ ঝরছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি বলতে পার, লুলু যা বলেছে তাতে কোনোরকম সত্যের স্পর্শ নেই? আমার কথা শুনে দুরদানা কাঁধ আঁকালো, তারপর বলল, আমাকে শার্ট-প্যান্ট পরা দেখে কোনো মেয়ে যদি মনে করে আমি তার ইয়ে, শুনতে তো আমার বেশ লাগে। কথাগুলো হজম করতে আমার কষ্ট হচ্ছিল। সেটা দুরদানার দৃষ্টি এড়ালো না। বলল, জাহিদ ভাই, আপনি আচাভুয়ো ধরনের মানুষ। সংসার অনেক জটিল। এখানে কত ধরনের মানুষ । সেসব ভেবে আর কি হবে। নিন, কাপড়-চোপড় পরে নিন। সন্ধ্যে হয়ে এল। তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে কাপড়-চোপড় পরতে লাগলাম।