নিজের অজান্তেই আরেকটি গোপন পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে গেলাম। সেই পৃথিবী চোখের সামনে দৃশ্যমান পৃথিবীর কোনো নিয়ম রক্ষা করে না। সেখানে সূর্য ভিন্ন রকম আলো ছড়ায়, চাঁদ ভিন্ন রকম কিরণধারা বিতরণ করে, সেই পৃথিবীর আকাশে ভিন্ন রকমের গ্রহ-নক্ষত্র শোভা বিস্তার করে। শিশুদের চোখে ম্যাজিক ল্যান্টার্নের ফোকর দিয়ে যেমন মায়া-জগতের চেহারা মূর্ত হয়ে ওঠে, আমিও দুরদানার মধ্য দিয়ে একটি গোপন পৃথিবীর নিবিড় স্পর্শ অনুভব করে একা একা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছিলাম। দুরদানা যখন আমার সামনে এসে দাঁড়াতো, আমার শরীরের সমস্ত রক্ত মিছিল করে উজানে ছুটতে থাকত। তরল রঙিন মদের নেশার মতো আমার চেতনার মধ্যে সোনালি বুদ্বুদ খেলা করত।
দুরদানা একটি মেয়ে, একটি অজানা পৃথিবীর প্রতীক। এই ভাবনাটাই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। তার স্তন জোড়ার আকৃতি কি রকম, অন্য মহিলার মতো তারও একখানা যৌনাঙ্গ আছে কি না, মাসে মাসে তারও রক্তস্রাব হয় কি না এবং যন্ত্রণা সে অনুভব করে কি না- এসব কথা কখনো আমার ধর্তব্যে আসে নি। একজন যৌবনবতী নারীর রূপ ধরে আমাদের দেশের ইতিহাসের পাল্টা স্রোত, যা গ্রামে গঞ্জে সর্বত্র হাজার বছরের বাঁধন ঠেলে বেরিয়ে আসার জন্যে রক্তপাত ঘটাচ্ছিল, সেই প্রবাহটার সঙ্গেই দুরদানা আমার পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিল। নারী আসলে যা, তার বদলে যখন সে অন্যকিছুর প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়, তখন তার আকর্ষণ করার শক্তি হাজার গুণ বেড়ে যায়।
একটানা বেশ কয়েকটা মাস ঘোরের মধ্যে কেটে গেল। নিজের দিকে তাকাবার মোটেও ফুরসত পাই নি। এক শুক্রবারে ঘুম থেকে উঠে ঘরের চেহারা দেখে সারা গা কুটকুট করতে থাকল। অনেকদিন থেকে ঘরে ঝাড় পড়ে নি। দেয়ালের চারপাশে, ছাদে ঝুল জমেছে, তাতে অজস্র মাকড়সা বাসা বেঁধেছে। বালিশ ময়লা। বিছানার চাদর অনেকদিন বদলানো হয়নি। এখানে-ওখানে কাগজপত্র ছড়িয়ে আছে। আমি নাস্তা শেষ করে এসে প্রথমে ঝুল ঝাড়লাম। তারপর বিছানার চাদর, বালিশের ওসার, তোয়ালে এইসব সাবান মেখে বালতিতে ডুবিয়ে রাখলাম। নতুন চাদর বের করে বিছানায় পেতে দিলাম, বালিশে নতুন ওসার লাগালাম। বইপত্রগুলো গোছগাছ করলাম। অনেকগুলো চিঠির জবাব দেয়া হয়নি। মনের মধ্যে অপরাধবোধের পীড়ন অনুভব করলাম। মায়ের পর পর তিনটে চিঠির কোনো জবাব দিইনি। ঠিক করলাম, প্রথমে মাকে, তারপর চাচাকে চিঠি লিখব। বাকি চিঠিগুলোর জবাব অন্য সময় দেব। কাপড়-চোপড় পরিষ্কার এবং চিঠিপত্র লেখায় অর্ধেক বেলা চলে গেল। ফলে আমি ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। দুপুরবেলা খেয়ে এসে বিছানায় পিঠ রেখেছি, এমন সময় দরজায় একে একে তিনবার টোকা পড়ল। আমি তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দিতেই একজন বুড়োমতো ভদ্রলোক আমাকে সালাম দিলেন। আগন্তুক বেশ লম্বা, মুখেছাগল দাড়ি। পরনে পাজামা এবং লম্বা নীল রঙের শার্ট। শার্টের তিনদিকে পকেট। দেখলাম, তার ওপরের পাটির দুটো দাঁত নেই। আমি ভদ্রলোককে বসতে বললাম এবং কি কারণে এসেছেন জানতে তিনি একগাল অমায়িক হেসে জানালেন, তার তেমন বিশেষ উদ্দেশ্য নেই। আমার সঙ্গে অল্পস্বল্প কথাবার্তা বলতে এসেছেন। আমার সঙ্গে তার কখনো পরিচয় হয়েছিল কি না জানতে চাইলাম। ভদ্রলোক এবারও হেসে জানালেন, না, আমার সঙ্গে তার মৌখিক পরিচয় হয়নি বটে, তবে তিনি আমাকে চেনেন। নানা-সভা-সমিতিতে তিনি আমার বক্তৃতা শুনেছেন। আমার কথাবার্তা শুনে খুব পছন্দ হয়েছে। তাই আজ পরিচয় করতে ছুটে এসেছেন।
ভদ্রলোকের কথাবার্তা শুনে আমার বুকের ছাতি একটুখানি ফুলে উঠল । তার দিকে সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরলাম। তিনি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেন এবং জানালেন, পান, সিগারেট, চা কিছুই খান না। কেবল দুপুরে এবং রাতে খাওয়ার পর মুখশুদ্ধির জন্য অর্ধেক করে হরতকি খেয়ে থাকেন। মৃদু হেসে এও জানালেন, হরতুকি সেবনের এই অভ্যাস তিনি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক অম্বিকা বাবুর কাছ থেকে পেয়েছিলেন। হরতুকি খুব উপকারী জিনিস। এ ছাড়াও তিনি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে পুরো এক গ্লাস ত্রিফলা-ভেজানো পানি পান করে থাকেন। আর এই পানির গুণ এত বেশি যে, পিত্তচড়া, অগ্নিমান্দ্য এসব রোগ ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারে না। ভদ্রলোকের কথাবার্তা শুনে তার ওপর আমার ক্রমশ শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এই রকম একজন সাত্ত্বিক স্বভাবের মানুষ সভা-সমিতিতে আমার বক্তৃতা শুনে আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন শুনে মনটা খুশিতে গান গেয়ে উঠতে চাইল।
আমার উম্মা, বিরক্তি সব কোথায় চলে গেল। আমি তরিবতসহকারে ভদ্রলোক কোথায় থাকেন জানতে চাইলাম। ভদ্রলোক জানালেন, তিনি আমার খুব কাছেই নীলক্ষেতের একটা অফিসে ছোটখাট গোছের কাজ করেন। তার আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি খুকখুক করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, অত্যন্ত তুচ্ছ ব্যাপার। স্যার, শুনলে আপনার হাসি পাবে। আমি বললাম, তবু আপনি বলুন। তিনি এক গ্লাস পানি খেতে চাইলেন। আমি পানি ভর্তি গ্লাসটা তার সামনে বাড়িয়ে দিলাম। তিনি আস্তে আস্তে ঢোক গিলে গিলে সবটুকু পানি পান করলেন। তারপর মুখ খুললেন, স্যারকে প্রতিদিন দুরদানা বেগমের সঙ্গে চলাফেরা করতে দেখি। এরকম ভাল দাগহীন মেয়ে আমি কম দেখেছি। প্যান্ট-শার্ট পরে একটু পাগলামি করলে কি হবে, একেবারে খাঁটি মেয়ে। ওই মেয়ের মধ্যে কোনোরকম নোংরামি থাকতে পারে না। আসলে স্যার আমরা মুসলমানরা যতই পর্দা-পর্দা বলে যতই চিৎকার করি না কেন, পর্দা করলেই যে মানুষের স্বভাবের পরিবর্তন হয়ে যাবে, এটা কোনোদিন ঠিক হতে পারে না। যাকে বলে ঘোমটার মধ্যে খেমটা নাচ, সে তো সব জায়গাতেই চলছে।