মওলানা হান্নানের মুখের ভাবে একটা পরিবর্তন এল, জাহিদ, আমি তোমার ভালর জন্যেই বলছিলাম, দুরদানা বেগমের সঙ্গে তোমার মেলামেশা ঠিক হচ্ছে না । কথাটা শুনে চটে উঠলাম, হান্নান, হঠাৎ করে আমার ভাল-মন্দ নিয়ে তুমি এমন আগ্রহী হয়ে উঠলে কেন? সে বলল, আহা ভাই চটো কেন? দুরদানা বেগম একটা বিপজ্জনক মহিলা। সে প্যান্ট-শার্ট পরে, গলায় মেশিনগানের বুলেটের হার ঝোলায়, পকেটে এই এ্যাত্তবড় চাকু রাখে, ব্যাটাছেলেদের কাঁধে হাত দিয়ে কথা বলে, ভুস ভুস ধোয়া ছেড়ে সিগারেট খায়, আর সাইকেলে চড়ে যেখানে-সেখানে চলে যায়। বন্ধু হিসেবে বলছি, এই রকম মেয়েছেলের সঙ্গে চলাফেরা করলে তোমার নামে কলঙ্ক রটে যাবে। তার অনেক খবর আমি রাখি। তবে একটা কথা তোমাকে বলি, দুরদানা সত্যিকার মেয়েছেলে কি না আমার সন্দেহ আছে। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল দুরদানাকে গিয়ে ডেকে আনি এবং বলি, দুরদানা, তোমার ছুরিখানা মওলানা হান্নানের থলথলে হুঁড়িটার মধ্যে ঢুকিয়ে দাও। সেটি যখন আপাতত সম্ভব হচ্ছে না হান্নানের সঙ্গে রসিকতা করার ইচ্ছেটাই আমার প্রবল হয়ে উঠল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মওলানা, দুরদানা যে মেয়ে না, কি করে তোমার এ সন্দেহ জন্মাল? হান্নান কানে গোঁজা আতর মাখানো তুলোর টুকরোটি বের করে নিয়ে আমার নাকে চেপে ধরল। তারপর বলল, শুঁকে দেখো, গন্ধ কেমন। উৎকট বোটকা গন্ধে আমার কাশি এসে গেল। সেদিকে খেয়াল না করেই বলল, মেয়ে মানুষের হওয়া উচিত এই আতরের গন্ধের মতো এবং আরো হওয়া উচিত মাখনের মতো তুলতুলে নরম । যে মেয়েমানুষ প্যান্ট-শার্ট পরে, সিগারেট খায়, ব্যাটাছেলের কাঁধে হাত দিয়ে চলাফেরা করে, যখন-তখন সাইকেলে চড়ে জায়গা-অজায়গায় যাওয়া-আসা করে, তার মধ্যে মেয়েমানুষের কি থাকে? আমার কথাগুলো তুমি একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখো। আমি বললাম, মওলানা আতরের ঘ্রাণের মতো, মাখনের মতো তুলতুলে মেয়ে মানুষের কথা তুমি এবাদত করার সময় চিন্তা করতে থাক, আল্লাহ মেহেরবান, মিলিয়েও দিতে পারেন। আমি চলোম। রাগে-ক্ষোভে হান্নানের ছাতিটা দশ হাত দূরে ছুঁড়ে দিয়ে আমি চলে এসেছিলাম।
হান্নান মওলানার কবল থেকে রেহাই পেয়ে আমি তো হোস্টেলে এলাম। কিন্তু তারপর থেকে আমার মনে একটা চিন্তা জন্ম নিল। মওলানার জগৎ বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদ, বাসা এবং নিউমার্কেটের কাঁচাবাজার। এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অথচ দুরদানার সমস্ত সংবাদ তার নখদর্পণে। আমি দুপায়ে সমস্ত ঢাকা শহর চষে বেড়াচ্ছি কিন্তু দুরদানার বিষয়ে কোনো কিছু জানিনে। নিজের সম্পর্কে একটা ধারণা ছিল। সেটা ভেঙে গেল । নিজের ওপর চটে গেলাম। সেদিন দুপুরে খাওয়ার পর সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। কখন রাজ্যের ঘুম এসে আমার সমস্ত চেতনা আচ্ছন্ন করে ফেলল, টেরই পাইনি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একটা বিদঘুঁটে স্বপ্ন দেখলাম। আমি একটা মোটরযানের ওপর চড়েছি। গাড়ি, ট্রাক, পিকআপ, এমনকি জিপের সঙ্গেও যানবাহনটির তুলনা চলে না। বাইরে থেকে দেখলে অনেকটা মিলিটারির ট্যাঙ্কের মতো দেখায়। কিন্তু ভেতরের আসন ইত্যাদি সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। এই যন্ত্রযান তীব্রবেগে সামনের দিকে ছুটে যাচ্ছে। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, শহরের বাঁধানো রাজপথ দিয়ে যানটা চলছে না। ঘরবাড়ি ইলেকট্রিক পোস্ট সবকিছু তছনছ করে অত্যন্ত মসৃণ গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর একজন মহিলা ডান হাতে স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাচ্ছে এবং বাম হাতে সিগারেট টানছে। ভদ্রমহিলার চেহারা ভাল করে চোখে পড়ছে না। আমি শুধু তার মুখের একটা অংশ দেখতে পাচ্ছি। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ঘুম ভেঙে গেল। জেগে ওঠার পরও অনেকক্ষণ পর্যন্ত ইঞ্জিনের ভন ভন শব্দ আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। ক্রমাগত নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগলাম, এরকম একটা উদ্ভট স্বপ্ন দেখলাম কেন!
.
০৫.
দুদিন বাদে হুমাযুন শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে আমাকে পাকড়াও করে বলল, জাহিদ ভাই, আপনার সঙ্গে কথা আছে। আমি বললাম, বলে ফেল। হুমায়ুন বলল, আপনি চা-টা শেষ করুন, এখানে বলা যাবে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ভাল, না খারাপ কথা। হুমায়ুন বলল, সে আপনি পরে বিবেচনা করবেন। তারপর সে আমাকে রমনা রেসকোর্সের এক কোণায় নিয়ে গেল। হাজি শাহবাজের মসজিদের উত্তর দিকের ঝাঁকড়া বিলেতি গাব গাছটার গোড়ায় গিয়ে পা ছড়িয়ে বসল। আমাকেও বলল, জাহিদ ভাই, বসুন। তার কথামতো আমিও বসে পড়লাম। ভেবে পাচ্ছিলাম না, হুমায়ুনের এমন কি গোপন কথা থাকতে পারে বলার জন্যে এতদূরে এই নির্জন গাছতলায় টেনে নিয়ে আসার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। হুমায়ুন বলল, আমাকে একটা স্টার সিগারেট দেন। প্যাকেট খুলে একটা নিজে ধরালাম, আরেকটা ওকে ধরিয়ে দিলাম। হুমায়ুন সিগারেটে লম্বা টান দিল, তারপর নাক-মুখ দিয়ে ধোয়া ছেড়ে বলল, জাহিদ ভাই, আপনাকে একটা ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দেয়ার জন্যে এই এতদূরে নিয়ে এসেছি। আমি বললাম, আমি কি তোমার কোনো ক্ষতি করেছি? হুমায়ুন বলল, আপনি সবসময় আমার উপকারই করেছেন। কিন্তু আপনি নিজের ক্ষতি করতে যাচ্ছেন। আমি একটুখানি চমকে গিয়ে বললাম, আমি নিজের ক্ষতি করতে যাচ্ছি! কিভাবে? হুমায়ুন বলল, দুরদানার সঙ্গে আপনি ইদানীং খুব ঘোরাঘুরি করছেন, কাজটা ভাল হচ্ছে না। আমি বললাম, বুঝিয়ে বলল, কেন ভাল হচ্ছে না। হুমায়ুন বলল, মহিলা অসম্ভব রকম ড্যাঞ্জারাস। আমি বললাম, ড্যাঞ্জারাস মহিলাদের আলাদা আকর্ষণ আছে, সেকথা চিন্তা করে দেখেছ? আপনি রসিকতা করে উড়িয়ে দিতে চাইছেন, কিন্তু জিনিসটা খেলা নয়, তার স্বরে একটা চাপা উত্তেজনার আভাস। আমি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে মনের ভাষা বুঝতে চেষ্টা করলাম। হুমায়ুনের মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। সে বলতে থাকল, জানেন, আমরা আপনাকে কি রকম শ্রদ্ধা করি, আপনাকে এমন কাজ করতে দিতে পারিনে, যাতে সে শ্রদ্ধার ভাবটি চলে যায়। একটুখানি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। হুমায়ুন কি বলতে চাইছে, সেটাই আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হচ্ছিল না। আমি বললাম, তোমরা শ্রদ্ধা করো, ঘৃণা করো, সে তোমাদের ব্যাপার। আমি তোমাকে বলিনি যে আমাকে শ্রদ্ধা করতে হবে। আর যদি শ্রদ্ধাই করো, তোমাকে খুলে বলতে হবে, কি কারণে সেটা চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। হুমায়ুন বলল, আপনি দুরদানার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবেন না। আমি বললাম, কেন রাখব না, সেটা বুঝিয়ে বলতে হবে। তোমার সঙ্গে ওই মহিলার হৃদয়ঘটিত কোনো ব্যাপার আছে? হুমায়ুন থু করে একদলা থুথু ফেলল, আমাকে কি এতই বাজে লোক মনে করেন যে, ওই মহিলার সঙ্গে হৃদয়ঘটিত সম্পর্ক তৈরি করব! তার সবটাইতো শরীর, হৃদয় কোথায়? আমি বললাম, মহিলার শরীর মন্দ জিনিস নয়, রোগা ছিপছিপে মহিলাকে নিয়ে ঘর করে আসছ, শরীরের মাহাত্ম বোঝার সুযোগ পাও নি, তাই এ কথা বলছ।