কী মশাই, রয়েছেন এখনও? তা হলে দেখছি—পাড়ার পাঁচজনের কথাই সত্যিই। আমি তো বিশ্বাস করতেই চাইছিলাম না। বলছিলাম, না না, ভদ্রলোকে আর একটি দিনের জন্যে দেখলাম না, নিশ্চয় চলে গেছেন। তা আছেন কোথায়?
কমলাক্ষর ইচ্ছে হল লোকটাকে ঠেলে সরিয়ে বেরিয়ে যান। কিন্তু এ-প্রনের সাধু ইচ্ছের পূরণ আর কবে কার হয়? তাই উত্তর দিতে হল। যেখানে ছিলাম, সেখানেই আছি।
অ! তা হলে ওদের সব কথাই বর্ণে বর্ণে সত্য। তা এত কাণ্ডের পরও ওখানেই রয়ে গেলেন তা হলে?
কমলাক্ষর ধৈর্যচ্যুতি ঘটছিল। রুক্ষ হয়ে উঠলেন তিনি।
কাণ্ড-টাণ্ডগুলোর খবর তা হলে পেয়েছেন আপনারা? আমি ভেবেছিলাম পাননি।
কেন, ছুটে গিয়ে ব্রজেন ঘোষের মড়ায় কঁধ দিইনি বলেই? দুদিন বেড়াতে এসেছেন, এখনও চোখে কলকাতার ঘোর লেগে রয়েছে, তাই মেজাজ এত শরী। বলি মশাই—যে লক্ষ্মীছাড়া লোক চাকর হয়ে মনিবের ঘরের মেয়েকে বার করে এনে স্বামী-স্ত্রী সেজে লোকের চোখে ধুলো দিয়ে, হাতে ভাত খাইয়ে জাত নষ্ট করে, আর মদের পয়সা জোটেনি বলে ইসপিরিট খেয়ে মরে কেলেঙ্কার করে, তার মড়ায় কে কাঁধ দেবে? দিইনি বলে মোটেই নিজেকে মস্ত একটা অপরাধী মনে করছি না।
কমলাক্ষ ঠাণ্ডা হয়ে গেলেন। তাকিয়ে রইলেন গগন গাঙুলীর মুখের দিকে। কমলাক্ষর জন্যে আর কতগুলো হাতুড়ির ঘা আছে?
ওই হাঁ করা মুখের দিকে তাকিয়ে গগন গাঙুলী বড়ো আমোদ পাচ্ছেন। মুখটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে।
রইলেন এতদিন, অথচ এলেন না তো মশাই একদিন! তা হলে ভেতরের সব ঘটনাটাই শোনাতে পারতাম।
শোনবার জন্যে খুব বেশি উদগ্রীব নই আমি। বলে জোর পায়ে এগিয়ে যান কমলাক্ষ, গগন গাঙ্গুলীকে প্রায় ঠেলেই।
অদ্ভুত লাগছে! ভারী অদ্ভুত লাগছে!
চারিদিক থেকে যেন জটিলতার জাল এসে ঘিরে ধরেছে। একটা সুটকেস ভর্তি বই এনেছিলেন কমলাক্ষ! শুধু পৃথিবীর একটুকু নিভৃত কোণ আর খানকতক বই এই সম্বল করে ছুটির একটা মাস কাটিয়ে দেবেন ঠিক করেছিলেন না?
সে দিন আর পাওয়া গেল না।
কিন্তু হিসেব করে দেখলে চার-পাঁচটা দিন তো একেবারে মনের মতো অবস্থাই পেয়েছিলেন কমলাক্ষ! কই, বইয়ের সুটকেস খুলেছিলেন কই! হাতও তো দেননি একখানা বইয়ে। কী করেছিলেন তবে সন্ধ্যা আর দুপুর?
কী করেছিলেন মনে করতে পারলেন না। মনে পড়ল ঘরের পিছনে মাঠের দিকে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছেন মাঝে মাঝে। হয়তো অনেকক্ষণ ধরে।
তবু কতক্ষণ? কি ভেবেছেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?
কলকাতার কথা? কলেজের সমস্যা? খাতা দেখা ফাঁকি দেওয়া? কই? পলাশপুর আসার আগের কমলাক্ষকে কি মনে ছিল পলাশপুরে আসা কমলাক্ষর? এ তো বড়ো সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড! মাঝে মাঝে তো কত জায়গাতেই যান, কই এমন আত্মবিস্মৃত ভাব তো আসে না।
কমলাক্ষ কি পূর্বজন্ম মানবেন? মেনে ভাববেন পূর্বজন্মে তিনি এই পলাশপুরে ছিলেন? তাই জন্মান্তরের পথ বেয়ে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ভুলে যাওয়া স্মৃতির রেশ? সেই রেশ উন্মনা করছে কমলাক্ষকে, ব্যাকুল করছে?
হঠাৎ মনে হল শুধু পূর্বজন্মের স্মৃতিই নয়, পূর্বজন্মের শত্রুও কেউ ছিল। সে কমলাক্ষকে নিয়ে মজা দেখতে চায়। নইলে কত লোক এসেছে ব্ৰজেন ঘোষের প্রবাস আবাসে, ঠিক কমলাক্ষর উপস্থিতির অবসরেই মদের অভাবে স্পিরিট খেয়ে মরে কেলেঙ্কারি করবার বাসনা হল ব্রজেন ঘোষের?
তা গগন গাঙুলীর কথাই কি নির্ভেজাল? এই বিদঘুঁটে কথাটা সত্যি?
সত্যি নয়,—একথাও জোর করে ভাবতে পারলেন না কমলাক্ষ। এটা টের পেয়েছেন গগন গাঙুলী, এই পলাশপুরের গেজেটের খবর উনি যেমন সরবরাহ করেন, তেমনি খবর আসেও ওঁর কাছে। মনে পড়ল ব্রজেনের সেই ছটফটানি, বুক পেট জ্বলে গেল।
ডাক্তার বলল ফুড পয়জন। বলে দিল যা হয় একটা কিছু বুঝতে পারছি না বলতে হলে তো মান থাকে না। বিশেষ করে মফঃস্বলের হাতুড়েদের। আর সত্যি সে বেচারা ধারণাই বা করবে কি করে লোকটা স্পিরিট খেয়ে মরতে বসেছে।
আচ্ছা সত্যিই খেয়েছে? মদের পয়সার অভাব হল কেন? লীলার কাছে তো অনেকগুলো টাকা ছিল। লীলা দেয়নি? টাকা কার? লীলা মনিবের মেয়ে, ব্ৰজেন ঘোষ চাকর। চাকরের সঙ্গে চলে এসেছে লীলা? তাই তাদের আত্মীয় নেই বন্ধু নেই? তাই প্রতিবেশীরা তাদের দেখে না?
কিন্তু এতদিন ধরে সকলের চোখে ধুলো দিয়ে চালিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ কমলাক্ষকে দেখেই বা সে-ধুলো উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করল কেন লীলার? ব্রজেন ঘোষ মারা গেল বলে?
রাস্তায় কেন বেরিয়েছিলেন মনে পড়ল না কমলাক্ষর। হঠাৎ যখন খেয়াল হল রোদটা বড়ো চড়া হয়ে উঠেছে, তখন ফিরতি মুখ ধরলেন। আর বাড়ির কাছাকাছি আসতে আসতে একটা আশ্চর্য সত্য আবিষ্কার করলেন।
এত কথা শোনার পর, আর সে-সব কথা প্রায় বিশ্বাস করে নেওয়ারও পরে লীলাকে লীলাই মনে হচ্ছে। ভয়ানক একটা ঘৃণ্য অপবিত্র কদর্য জীব বলে মনে হচ্ছে না।
৩. তাহলে ফিরে এলেন
তাহলে ফিরে এলেন? আমি ভাবছিলাম রাগে-ঘেন্নায় বোধ হয় চলেই গেলেন। করুণাপদ পড়ে, ভেবে পাচ্ছিলাম না কাকে দিয়ে আপনার জিনিসগুলো স্টেশনে পাঠিয়ে দেব। ট্রেনের সময় অবধি থাকতেনই তো স্টেশনে।
কমলাক্ষর এতক্ষণে মনে পড়ল তার হাটে যাওয়ার কথা ছিল। মনে পড়ল করুণাপদর জন্যে একটু ওষুধ আনবেন ভেবেছিলেন। কিচ্ছু করেননি। শুধু হাতে ফিরেছেন।