কী আশ্চর্য! আপনি কি আমাকে একটা জানোয়ার ঠাওরেছেন? তাই আজ আমার খাবার ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করছেন?
কাল রাত থেকে তো খাওয়া হয়নি—
কমলাক্ষ খপ্ করে বলে ওঠেন, সে তো আপনারও হয়নি।
আমার? তা হয়নি বটে। বলে টাকাটা আঁচলে বাঁধতে লাগল লীলা।
একটু বেশিক্ষণ কি সময় লাগল তার? গিটটা কি বার বার আলগা হয়ে যাচ্ছিল? তা বাঁধার পরও দাঁড়িয়েই থাকল কেন?
কমলাক্ষ একটু চুপ করে থেকে বলেন, আপনি তো একটু শরবতও খেতে পারতেন!
তা পারতাম।
কি আর বলব। কমলাক্ষ একটা নিশ্বাস ফেলেন, এমন অবস্থা আপনার, কেউ যে একটু জল এগিয়ে দেবে–
কথাটা শেষ করা নিরর্থক বলেই হয়তো করলেন না কমলাক্ষ। লীলাও এই অসম্পূর্ণ কথার কোনো উত্তর দিল না। আস্তে বলল, যাই।
ও চলে গেলে কমলাক্ষর মনে হল কথাবার্তায় তিনি বড়ো অপটু। এরকম সদ্য শোকাহত মানুষকে একটু সান্ত্বনা দিয়ে কথা বলা বোধ হয় উচিত ছিল। কিন্তু কী-ই বা বলবেন? বাজার চলতি সেই হেঁদো কথাগুলো? কী আর করবে! এই তো জগৎ-ইত্যাদি! ছিঃ!
ভাবলেন ব্ৰজেন ঘোষের বউ যদি ব্রজেন ঘোষের মতোই হত, হয়তো চেষ্টা করে ওরকম দুএকটা কথা বলতে পারতেন। অন্তত চেষ্টাও করতেন। আর ওই টাকাটা রাখতে এলে বলতে পারতেন, সে কি! বিপদের সময় মানুষ মানুষের করবে না? ও-টাকা আপনি রাখুন, শোধ দিতে হবে না।
কিন্তু ব্ৰজেন ঘোষের স্ত্রী ব্রজেন ঘোষের মতো নয়। কোথায় যেন আকাশ পাতাল তফাত। আশ্চর্য রকমের অন্যরকম। তাই কমলাক্ষ নিতান্ত অপটুর মতো বসে রইলেন। এটুকুও বলতে পারলেন না, করুণাপদ না উঠুক, আমিই যাচ্ছি। বাজার থেকে একটু মিষ্টি এনে দিচ্ছি, জল খান আপনি। বাঁচতে তো হবে।
অথচ ঠিক ওই কথাগুলোই বলতে ইচ্ছে করছিল। ওই রকমই কিছু একটা করতে ইচ্ছে করছিল। কোনো মেয়ের খাওয়া হয়েছে কি হয়নি এ-খোঁজ কমলাক্ষ জীবনে কখনও করেছেন?
.
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মাঠের দিকের সেই জানলাগুলো খুলে দিলেন কমলাক্ষ। খুব খানিকটা বাতাস এসে পড়ল একসঙ্গে। কমলাক্ষ দাঁড়িয়ে থাকলেন জানলার কাছে।
আর একবার ভাবলেন, কি উচিত তার এখন? থাকবেন, না চলে যাবেন? হোটেলের মালিক মারা যাবার পর, কেবলমাত্র অগ্রিম চার্জ দেওয়ার ছুতোয় মালিকের স্ত্রীর ওপর জুলুম চালিয়ে খাওয়াদাওয়া চালিয়ে যাওয়া সঙ্গত?
অথচ এটাও ভেবে পেলেন না, আত্মীয়স্বজন বলতে যার আর কেউ কোথাও নেই, পাড়ার লোকে যার মুখ দেখে না, তাকে একলা অসহায় এই মাঠের মাঝখানের একটা বাড়িতে ফেলে চলে যাওয়া যায় কি করে?
কমলাক্ষকে এ-দায়িত্ব কে দিল কে জানে! তবু কমলাক্ষ না ভেবে পারছেন না। ব্ৰজেন ঘোষের এই হোটেল এরপর আর কি চলবে? লীনা কি একা হোটেল চালাতে পারবে? কত রকমের লোক আসতে পারে, কত অসৎ লোক। আর চারিদিকেই তো শত্রু ওর।
নাঃ, অসম্ভব!
তা শুধু চারিদিকেই নয়, ওপর দিকেও শত্রু লীলার। নইলে করুণাপদ অমন ঘাড় ভেঙে জ্বরে পড়বে কেন?
দেখছি আপনাকেই আজ হাটে যেতে হবে–চায়ের পেয়ালাটি সামনে নামিয়ে রেখে কথাটি শেষ করল লীলা, করুণাপদ তো দিব্যি জ্বর বাধিয়ে বসল। অথচ আজ হাট
কমলাক্ষ চিরদিনই অন্যমনস্ক প্রকৃতির। কোনোদিনই সমাজব্যবস্থা আচার-নিয়ম সম্পর্কে মাথা ঘামাননি। তবু কমলাক্ষর চোখে পড়ল, মানে চোখে না পড়ে পারল না, নতুন বৈধব্যের বেশ ধারণ করেনি লীলা। আগেও যেমন ছিল তেমনিই রয়েছে দেখে বিস্ময় বোধ করলেন কমলাক্ষ। আবার কৃতজ্ঞও হলেন। সেই একটা কি যেন ভয়ঙ্কর ব্যাপার আছে! ভাবলেই হৃঙ্কম্প হয়।
আস্তে বললেন, হাটের দরকার বোধ হয় শুধু আমারই জন্যে? করুণাপদর তো জ্বর হয়েছে। আর আপনারও–
না, আমার আর জ্বর হল কই? আমি তো দিব্যি—ভালোই আছি! জানলার বাইরে তাকিয়ে বথ বলছে লীলা। কমলাক্ষর মনে হল, ও যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছে।
একটু থেমে কুণ্ঠিতকণ্ঠে বললেন, না তা ভাবছি না। মানে আপনি তো আর ভাত-টাত—মানে ফল-টল ছাড়া আর কিছু তো–
লীলা হাসল। হাসির মতো নয়, সত্যিকার হাসি। হেসে বলল, আপনার মতো লোকের হেফাজতে যে-মেয়ে থাকতে পারে তার আর জীবনে কোনো দুঃখ থাকে না। আপনার স্ত্রীকে এত ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে যে
কমলাক্ষও হাসলেন। বললেন, যাই মনে হোক, এই মর্ত্যলোকের কোনো কিছুই আর তার কাছ পর্যন্ত পৌঁছবে না?
লীলার মুখের হাসিটা মিলাল! নেই বুঝি?
নাঃ, বহুকাল আগেই—
তাই হবে। সেটাই স্বাভাবিক। কমলাক্ষর মনে হয়, এখনও যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছে লীলা, বাংলাদেশের মেয়ে তো! এত বেশি সৌভাগ্যের ভার কতদিন আর বইবে? তারপর সহসাই যেন সচকিত হয়ে বলে ওঠে, না, ফল-টল কিছু লাগবে না। আপনিও যা খাবেন, আমিও তাই খাব। অবাক হচ্ছেন? হওয়াই সম্ভব। কিন্তু কি জানি কেন হঠাৎ বড় ইচ্ছে হচ্ছে আপনাকে সত্যি কথাটা বলি–
সত্যি কথা! যন্ত্রের মতো উচ্চারণ করেন কমলাক্ষ।
লীলা মুখ তুলে শান্ত গলায় বলে, হ্যাঁ, সত্যি কথা। যে-কথা আজ পর্যন্ত কাউকেই বলা হয়ে ওঠেনি। বলা যায়নি। সেই কথাটাই বলছি আপনাকে। উনি আমার স্বামী ছিলেন না।
.
মাথার ওপর হঠাৎ এসে লাগা একটা হাতুড়ির আঘাতের অনুভূতি নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলেন কমলাক্ষ। সেই অসাড় অনুভূতি নিয়েই অনেকটা পথ চলেছিলেন। হঠাৎ আবার সেদিনের মতো পথরোধ হল।
আবার গগন গাঙুলী। চলেছেন হাটের পথে।