কমলাক্ষ ভাবলেন, আমি যদি হঠাৎ মারা যাই, ভবেশের চোখ দিয়ে জল পড়বে? তারপর ভাবলেন, খুব সম্ভব দোষ আমার নিজেরই। আমি কারোকে লক্ষ্য করি না, আমি কারও কাছে সেবা যত্ন প্রত্যাশা করি না, আর বোধ করি আমি কাউকে ভালোবাসতেও পারিনি। জানি না ভালোবাসতে।
গণ্ডমূর্খ ব্রজেন ঘোষ হয়তো ভালোবাসতে জানত। নইলে–
করুণাপদ কুণ্ঠিত পদে আবার এল, আর টাকা সঙ্গে আছে বাবু? একজনের ভাগে কিছু কম পড়ছে।
কমলাক্ষ আর একবার পকেটে হাত ঢোকালেন। কত কম পড়ছে?
আজ্ঞে তেরো আনা।
একটা টাকা এগিয়ে ধরলেন কমলাক্ষ। ভাবলেন, এই স্বভাব মানুষের। অপ্রতিবাদে পেলেই তার ভিতরের লোভের মন জেগে ওঠে। মোটা টাকা কবলেই ধরে এনেছিলেন ওদের। স্টেশনের ওদের। স্টেশনের ধারে ওই পানের দোকানটা থেকে। এটা ফাউ।
যাক। কাজটা হয়ে যাচ্ছে এই ঢের।
হয়ে যাচ্ছে। তা সত্যি। কিন্তু এর পরটা কি হবে? ভাবলেন কমলাক্ষ।
এক মাসের ছুটি নিয়ে চেঞ্জে এসেছিলেন না তিনি? তার সাতটা দিন কেটেছে। বাকি দিনগুলো নিয়ে এবার কি করবেন? কলকাতায় ফিরে যাবেন? গগন গাঙুলীর পরামর্শ নিতে যাবেন? না কি এক মাসের চার্জ অগ্রিম দিয়ে দিয়েছি এই অজুহাত দেখিয়ে প্রবাস আবাসের পিছনের দিকের ওই
পুব-দক্ষিণ খোলা ঘরখানা আঁকড়ে বসে থাকবেন?
রাত্রি হলেই যে-ঘরের জানলা দিয়ে মখমলের মতো মসৃণ মোলায়েম গাঢ় অন্ধকার দেখতে পাওয়া যায়, আর শেষ রাত্রি থেকে সে-অন্ধকার কাটবার যত কিছু আয়োজন সমস্তই দেখতে পাওয়া যায়, পর পর একটির পর একটি বইয়ের পাতা খোলার মতো। সূর্য ওঠার আগে যে এতরকম রঙের খেলা চলে, এটি কমলাক্ষ কোনোদিন দেখেননি?
হয়তো দেখেছেন। হয়তো কেন, নিশ্চয়ই দেখেছেন। কিন্তু দেখার চোখ কি সব সময় খোলা থাকে?
***
বেলা পড়ে গিয়েছিল।
এখন আর আকাশে সূর্য ওঠার খেলা নয়, সূর্য ডোবার। সেটা দেখা যায় না এ-ঘর থেকে। একগ্লাস চিনির শরবত খেয়ে ঘরটান এসে বসলেন কমলাক্ষ।
গত দুদিন থেকে এ-ঘরে আর আসেননি মনে পড়ল। সেই পরশু দুপুরের সময় ব্রজেনের বাড়াবাড়ির সূচনা দেখা দিয়েছিল যখন-তখন থেকে।
করুণাপদর ডাকে ওদের ঘরে গিয়ে অবস্থা দেখে লজ্জায় মারা গিয়েছিলেন কমলাক্ষ। আগের রাত্তির থেকে নাকি ওইরকম ছটফট করছে ব্রজেন। বলছে, পেট বুক সব জ্বলে গেল।
বিষের জ্বালা? কিন্তু ব্ৰজেন ঘোষ কেন বিষ খাবে?
না না, ফুড পয়জনই হয়েছিল ব্রজেনের। ডাক্তারও তো তাই বলল। তা ফুড পয়জনের ওষুধই কি পড়েছিল ব্ৰজেন ঘোষের পাকস্থলীতে? ডাক্তারকে অনুরোধ উপরোধ করে ডেকে আনতে, আর স্টেশনের ধার থেকে ওষুধ আনতে, নাড়ি ছেড়ে গিয়েছিল।
ছেড়ে যাওয়া নাড়ি আর কোন ওষুধের জোর চাঙ্গা হয়ে উঠবে?
কমলাক্ষ তাকিয়ে দেখলেন চিনির শরবতের তলানিটায় একটা মাছি পড়ল। নীল রঙা বড়ো মাপের মাছি। ব্রজেন ঘোষ বলেছিল সেদিন দুপুরে নাকি সে দোকানে বসে তরমুজের শরবত খেয়েছিল। ব্ৰজেন ঘোষের সেই শরবতে কি ওই রকম বড়ো মাপের একটা মাছি পড়েছিল?
চমকে দাঁড়িয়ে উঠতে হল কমলাক্ষকে।
মানে উঠলেন।
আর কেউ হলে হয়তো হোটেলওয়ালার বউকে সম্মান দেখাতে দাঁড়িয়ে উঠত না। মহিলাই ভাবত না তাকে। বলতে মেয়েমানুষ। কমলাক্ষ তা বলেননি। কিন্তু কমলাক্ষই কি ভেবেচিন্তে সম্মান দেখাতে দাঁড়িয়েছিলেন? তা নয়। দাঁড়িয়েছিলেন আকস্মিক চমকে উঠে। বিনা ভূমিকায় কথাটা বলে বসেছিল কিনা লীলা।
ওখানে তো শুনলাম পয়সা পয়সা করে আপনাকে খুব জ্বালাতন করেছে।
কমলাক্ষ বোধ করি এসময় ঠিক এ-ধরনের কথার জন্যে আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। তাই থতমত খেয়ে বলেন, না না, জ্বালাতন কি? জ্বালাতন কিছু না। মানে জ্বালাতন তো ওরা করবেই।
তা বটে। লীলা তার স্বভাবগত ভঙ্গিতে সেই একটু হাসির মতো সুরে বলে, জ্বালাতন করাই তো ওদের পেশা। কিন্তু আপনার কাছে আমার পেশাটাও প্রায় তাই দাঁড়াচ্ছে। ঋণশোধ কথাটা উচ্চারণ করবার ধৃষ্টতা নেই। কিন্তু একটু ধৃষ্টতা তো করতেই হচ্ছে। আগে, পরে, মাঝখানে, অনেক খরচপত্রই তো হয়ে গেল আপনার—
টেবিলের ওপর একগোছা দশটাকার নোট নামিয়ে রাখল লীলা। আর রাখার পর ঈষৎ হেসে বলে, আমি কিন্তু হিসেব করে মিটিয়ে দিতে পারব না। কম হলে কমই হল।
কমলাক্ষ একবার মুখ তুলে তাকালেন। মুখ দেখা গেল না। ভাবলেন লীলা যেন বড়ো বেশি প্র্যাকটিক্যাল। আজই তাড়াতাড়ি টাকাকড়ি
যদিও আজ সকাল পর্যন্ত নামটা জানতেন না কমলাক্ষ, শুধু শবদাহের সার্টিফিকেটের সূত্রে জেনেছেন, তবু ইতিমধ্যে ওকে লীলা ভাবতেই অভ্যাস হয়ে গেছে। তারপর ভাবলেন, এটাই স্বাভাবিক, আমি আর কে ওর? নিতান্ত পর বই নয়। পাকে চক্রে ওর বিপদের সময় একটু উপকারে লেগে গেছি বলেই কিছু আর আপনার লোক হয়ে যাইনি। ঋণ রাখতে চাইবে কেন?
তবু বললেন, এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে আপনি এখুনি এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?
ব্যস্ত কিছু না। রয়েছে হাতে—
তা হোক। এখন থাক।
আশঙ্কা করছিলেন হয়তো অনেক অনুরোধ আসবে, এবং শেষ পর্যন্ত নিতেই হবে। কিন্তু তা হল না। লীলা আস্তে নোটগুলো তুলে নিয়ে বলল, তবে থাক।
রাগ করলেন নাকি?
রাগ? তা হবে। যদি সেটাই সম্ভব বলে মনে হয় আপনার।
না না, মানে–
থাক। বুঝতে পেরেছি। কিন্তু শুনুন, আজ আর আপনি বাড়িতে খেতে পাবেন না। করুণাপদ চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। অথচ পরশু থেকে বাজার দোকান–