এবারও বললেন, ব্যবস্থার মতো ব্যবস্থা ঠিক করে আসিনি, তা এসে জুটেই গেল ঈশ্বর কৃপায়। রিকশাওলাই সন্ধান দিয়ে নিয়ে এল–
তা বেশ! ভালোই। পেটের মধ্যে বেশ কিছু কথা চেপে রেখে, এবং সেটা যে চেপে রেখেছেন, তা না চেপে, ভদ্রলোক কথা শেষ করেন। দুদিনের জন্যে বেড়াতে এসেছেন বেড়িয়ে যাবেন, এর আর কি। আজকাল তো হাড়ি ডোমও জল-চল হয়েছে। তা যাক, চলি। মশায়ের নামটি কি জানলাম না তো?
কমলাক্ষ বিরক্ত হচ্ছিলেন। কমলাক্ষ লোকটাকে অশ্রদ্ধা করছিলেন, তবু ভদ্রতার দায়েই উত্তরটা দিতে হয়, কমলাক্ষ মুখোপাধ্যায়।
মুখুজ্জে! ওঃ! একেবারে সাপের মাথার মণি! যাক প্রবাস হোটেলে উঠবেন একবার এই গগন গাঙুনী সঙ্গে যদি পরামর্শটা করতেন! আমি মশাই কখনও কারুর হিত বই অহিত চাই না। ওই যে আপনার ব্রজেন ঘোষ। যখন প্রথম এসেছিল এখানে—অভয় দিয়ে আশ্রয় দিয়ে কে এখানে শেকড় গাড়িয়েছিল ওকে? আর কেউ নয়—এই গগন গাঙুলী!
কমলাক্ষর মনে হল, যেন কোনো নাটকের একটি টাইপ চরিত্র এসে সামনে দাঁড়িয়েছে তার। বাচনভঙ্গি থেকে অঙ্গভঙ্গি পর্যন্ত যেন অতি পরিচিত। এক-মিনিট দাঁড়াতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, তবু দাঁড়াতে হয়েছিল। কারণ গগন গাঙুলী ছাড়ছিলেন না।
আমিই পরামর্শ দিয়েছিলাম। ওই হোটেল খোলবার পরামর্শটি আমিই দিয়েছিলাম। বলি, লেখাপড়া যখন বেশিদূর নয়, আর কলকেতায় কোনো কাজকর্ম জোগাড় করতে পারনি, তখন এখানেই সেট করে ফেল। এটা ভালো ব্যবসা, স্বাধীন ব্যবসা, তা ছাড়া এই গেরস্ত পরিচালিত হোটেলের চাহিদাও বেশি। এই অঞ্চলে নেই তো বিশেষ। অথচ স্বাস্থ্যকর জায়গা, লোকে বেড়াতে আসে। লাগিয়ে দাও, পেছনে আমি আছি।…সত্যি বলব মশাই, আমার নিজেরই ঝোঁক ছিল।…নেহাত স্ত্রীর আপত্তি। বলেছিঃ, শেষে লোকে আমাকে বলবে হোটেলওলি! তা স্ত্রীই যদি খাপ্পা হন মশাই, পয়সা নিয়ে কি ধুয়ে জল খাব? বলুন? তাই ওই ব্ৰজেন ঘোষকেই সাহায্য করে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছিলাম। তারপর মশাই—যাক! সে কথা যাক। কী করা হয় মশাইয়ের?
কমলাক্ষ মনে মনে ভাবেন, ওরে বুড়ো, তুমি ভাবছ ওই আধখানা কথা শুনিয়ে শুনিয়ে তুমি আমার কৌতূহল জাগ্রত করবে, আমিও তেমনি। কথাটি কইব না ও-সম্বন্ধে। তাই শুধু বলেন, এই ছেলেটেলে পড়াই।
পড়ান? ছেলেমেয়েদের—মানে টিউশানি? নাকি কোনো ইস্কুলে?
আজ্ঞে স্কুল ঠিক নয়। ইয়ে একটা কলেজে–
ওঃ তাই বলুন? প্রফেসর! তা বলতে হয় এতক্ষণ? আচ্ছা যান—বেড়াতে বেরিয়েছেন, আর জ্বালাতন করব না! দেখা হবেই অবিশ্যি আবার। এই পথেই তো পায়ের ধুলো দিতে হবে। একঘেয়ে মুখ দেখতে দেখতে অরুচি এসে গেছে মশাই! একটু নতুন মুখ দেখতে পেলে বর্তে যাই।
ভদ্রলোকের ব্যাকুলতাটা অবশ্য বুঝতে পেরেছিলেন কমলাক্ষ। বুঝেছিলেন, এরকম একটি মফঃস্বল টাউনে দীর্ঘকাল কাটাতে হলে একঘেয়ে মুখ দেখতে দেখতে এই রকমই অবস্থা হয়ে দাঁড়ায়।
বুঝেছিলেন। কিন্তু গগন গাঙুলীকে নতুন মুখ দেখাবার পুণ্য অর্জন করা আর হয়ে ওঠেনি কমলাক্ষর। পরদিন অন্য পথ ধরে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। তার পরদিনও। পর পর চারটে দিনই অন্ধকার থাকতে থাকতে বেরিয়ে পড়েছিলেন ওই সব নাম-না-জানা পাহাড়ের ঢিবির দিকে।
হ্যাঁ চারদিন। তারপর তো দুটো দিন বাড়িতেই বন্দী।
কিন্তু কমলাক্ষ কেন বন্দী হলেন?
জ্বলন্ত চিতার আওতা থেকে একটু সরে গিয়ে বসে সেই কথাই ভাবছিলেন কমলাক্ষ। কমলাক্ষ এক নাম-না-জানা জায়গার শ্মশানে এসে, অজানা ব্ৰজেন ঘোষের শবদেহ দাহ করছেন। এই চাইতে আশ্চর্য ঘটনা কমলাক্ষর জীবনে আর কবে ঘটেছে? শ্মশানে যাওয়া সম্পর্কে আবাল্য একটা ভীতি আছে কমলাক্ষর। নিতান্ত নিরুপায় অবস্থা না হলে, ওই মৃতের বাড়ি থেকেই বিদায় কর্তব্য সারেন। আর সঙ্গে যেতে হলেও এই বীভৎস কাণ্ডটাকে চোখের সামনে দেখার যন্ত্রণাটা এড়াতে পারলে ছাড়েন না।
মাঝে মাঝে ভেবেছেন, ঈশ্বর রক্ষা করেছিলেন তাই নীরজা মারা যাবার সময় কমলাক্ষ বিলেতে ছিলেন। ফিরে এসে নীরজাকে আর দেখতে পেলেন না, এ বেদনা বড়ো বেশি বেজেছিল বটে, তবু নীরজাকে যে হাতে করে পোড়াতে হল না তাকে, এটার জন্যে যেন ঈশ্বরের কাছে একটা কৃতজ্ঞতা অনুভব করেছিলেন। উপস্থিত থাকলে পোড়াতে তো কমলাক্ষকেই হত! তখন তো পুণ্ডরীকের মায়ের মুখে আগুন দেবার বয়েস আসেনি।
আজ কমলাক্ষ ব্ৰজেন ঘোষের শব বয়ে নিয়ে শ্মশানে এসেছেন। যে-ব্ৰজেন ঘোষকে মাত্র সাতদিন আগে চোখেও দেখেননি। অথচ এ ছাড়া উপায়ও ছিল না।
কতরকম অদ্ভুত পরিস্থিতিতেই পড়তে হয় মানুষকে!
করুণাপদ কাছে এসে বলল, মুখজ্জে বাবু, লোকগুলো তাড়ি খাবার পয়সা চাইছে।
তাড়ির পয়সা! এই দিন-দুপুরে তাড়ি খাবে ওরা! ভাবলেন কমলাক্ষ। কিন্তু কিছু বললেন না। পকেটে হাত ঢুকিয়ে যা উঠল এগিয়ে ধরলেন করুণাপদর দিকে। করুণাপদ সরে গেল।
কমলাক্ষ ভাবলেন, শুধু কি ধোঁয়ার জন্যেই চোখ দিয়ে জল পড়ছে করুণাপদের? ব্রজেন ঘোষের মড়া বার করবার সময় ওর মাথা খোঁড়াখুঁড়ি কি সাজানো? করুণাপদ তো ওদের চাকর মাত্র। সামান্য একটা চাকরের মধ্যে এত ভালোবাসা থাকে?
কমলাক্ষও তো সারা জীবন চাকর রাখলেন, কত আসে কত যায়, কই তার মধ্যে এমন একটা মুখও তো মনে পড়ছে না—যে-মুখটা মনে রয়ে গেছে। চাকরবাকর সম্বন্ধে কমপ্লেন শোনা ছাড়া চাকর সম্পর্কিত আর কিছু মনে করতে পারলেন না কমলাক্ষ। এমনকি এখনই কলকাতায় তার বাড়িতে যে-লোকটা রয়েছে—তার নামই অনেক ভেবে মনে আনতে হল। কী যেন? ভবেশ? হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে। যে-লোকটা খুব সম্ভব বছর তিনেক আছে, আর এই তিন বছরের মধ্যে তিনটে দিনও কমলাক্ষর জুতো জোড়াটা ঝেড়েছে আর মশারিটা টাঙিয়ে দিয়েছে কিনা সন্দেহ। ঘরের খাবার জলের কুঁজোটা না ভরে ভরে মাকড়শার জালে ঢাকা পড়ে গেছে। কমলাক্ষ রাতে শোবার আগে নিজেই কাঁচের গ্লাসে করে এক গ্লাস জল রাখেন। জুতোটা রুমাল দিয়ে ঝেড়ে নেন।