Fন্ধকারও যে দেখতে এত ভালো লাগে, তা তো কোনোদিন জানতেন না কমলাক্ষ। অন্ধকার দেখলেনই বা কবে? ভদ্রলোকেদের বেড়াতে যাবার উপযুক্ত জায়গাগুলির কোনোখানে আর অন্ধকার রেখেছে আধুনিক ব্যবস্থা?
কিন্তু অন্ধকারেরও কি একেবারেই দরকার নেই? ভাবলেন কমলাক্ষ। আছে দরকার। নিশ্চয় আছে। অবিরত চড়া আলো দেখতে দেখতে চোখের স্নায়ু শিরাগুলো যে ক্লান্ত হয়ে ওঠে, পীড়িত হয়ে ওঠে। গাঢ় ঘন কোমল এই অন্ধকার যেন কমলাক্ষর সেই ক্লান্ত হয়ে ওঠা, পীড়িত হয়ে পড়া স্নায়ু শিরাতে স্নিগ্ধ একটা ওষুধের প্রলেপ বুলিয়ে দিচ্ছে।
বাবু জল দিয়েছি।
চমকে উঠলেন কমলাক্ষ। ওঃ অনেকক্ষণ হয়ে গেছে দেখছি। তাড়াতাড়ি ফিরে দাঁড়ালেন। বললেন, কই, তোমার বাবু এসেছেন?
আজ্ঞে আসেননি, এই এসে যাবেন আর কি। তা তার জন্যে আপনার কিছু আটকাবে না বাবু। যা কিছু করবার মা আর আমিই করি। চলুন রাত হয়েছে খেতে বসবেন।
কমলাক্ষ কুণ্ঠিতভাবে বললেন, কিন্তু চার্জ-টার্জ কি রকম–
সে এমন কিছু নয় বাবু। খাওয়া থাকা নিয়ে দিন সাড়ে চার টাকা। তা খাওয়া আপনি চারবেলাই পাবেন। সকালে চা ডিমসিদ্ধ—
থাক্ থাক্–লজ্জিত কমলাক্ষ ব্যস্ত হয়ে বলেন, সে যা হয় হবে। চার্জ তো কমই। কিন্তু এখুনি যে খেতে বসিয়ে দিতে চাইছ, পাবে কোথায়? আমার জন্যে তো আর রান্না করে রাখনি?
করুণাপদ একগাল হেসে বলে, কী যে বলেন বাবু, একটা মানুষের খাওয়ার জন্যে আবার ভাবনা! বলি বাবুর জন্যে তো আছে কিছু, তার ওপর দুখানা ভাজা আর লুচি করে দিলেই-সে আপনি কিছু ভাববেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবু তো আর রাত এগারোটা বারোটার ইদিকে—ইয়ে চলুন বাবু চলুন, খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ুন, বাবুর সঙ্গে দেখা আপনার গিয়ে সেই কাল সকলেই
করুণাপদ হঠাৎ থামতে বাধ্য হয়। দালানের ওদিক থেকে অনুচ্চ একটি স্বর আসে, করুণা, বাজে কথা থামিয়ে একটু এদিকে এস তো!
কমলাক্ষর হঠাৎ মনে হল, এরা নিশ্চয়ই বেশ ভদ্রই। গলার সুরটা মার্জিত, কথার ধরনটা সভ্য।
২. সে-রাত্রে নয়
সে-রাত্রে নয়, সে-রাত্রে কমলাক্ষ ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। পরদিন বাবুকে দেখলেন। ব্রজেনবাবু।
রোগা পাকসিটে চেহারা, মুখচোরা মুখচোরা স্বভাব, দেখলে মনে হয় একটু পানদোষের ব্যাপার আছে বোধ হয়। অন্তত ওই রাত করে ফেরা আর চেহারার ধরনটা একত্র করে তেমনই একটা ধারণা জন্মেছিল কমলাক্ষর। কিন্তু ধারণা-টারনা কদিনের জন্যেই বা? সেদিনও কি কমলাক্ষ স্বপ্নেও কল্পনা করেছিলেন সাতদিনের মাথায় ব্ৰজেনবাবুকে নিয়ে শ্মশানে আসতে হবে তাকে?
সেদিন বলেছিলেন, মানে কথা বলতে হয় তাই বলেছিলেন, বাড়িটা কিনেছিলেন, না করিয়েছেন?
ব্ৰজেনবাবু নিজের হাতের আঙুলগুলোর দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আস্তে উত্তর দিয়েছিলেন, ইয়ে, এই সামনের পোরশানটুকু কিনেছিলাম, তারপর আপনার গিয়ে আস্তে আস্তে পিছন দিকটা—মানে এখানেই যখন সেট করা হল, করতে হবে তো একটা কিছু!
একটা কিছু করতে হবে বলে হোটেল খুলতে হবে? আর কিছু করবার ছিল না? এ-প্রশ্ন তোলেননি কমলাক্ষ। ভদ্রমহিলাটিকে দেখে যেমন মনে হয়েছিল, মানে যেরকম উচ্চশ্রেণীর মনে হয়েছিল, ব্ৰজেনবাবুকে দেখে ঠিক তা মনে হল না।
যাক ও নিয়ে কে মাথা ঘামায়? কেনই বা মাথা ঘামাবেন?
এটা ওটা কথার শেষে বেড়াতে বেরিয়ে পড়েছিলেন। ঠিক করেছেন সকাল বিকাল বেড়াবেন, আর দুপুর সন্ধ্যা বই পড়বেন। বেশ নিরিবিলি বাড়ি, আশেপাশে অন্য বোর্ডারদের ঝামেলা জোটেনি। বেশ লাগছে, বড়ো ভালো লাগছে।
খানিক পথ এগোতেই দাঁড়াতে হল। এক ভদ্রলোক পথরোধ করেছেন।
কী মশাই, আপনাকে যে একেবারে আনকোরা নতুন দেখাচ্ছে? কবে এসেছেন? নিশ্চয় বেশিদিন নয়। নইলে আমার চোখ এড়িয়ে
কমলাক্ষ সবিস্ময়ে এই আলাপী ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলেন। ভদ্রলোকের স্বভাবটি গায়ে-পড়া, সাজটি অদ্ভুত। সিল্কের লুঙ্গির ওপর একটা সুতির গলাবন্ধ কোট একটা চাপানো, পায়ে চপ্পল, মাথায় সোলা হ্যাট। এই সক্কালবেলাই ওনার মাথায় রোদ লাগছে নাকি?
কমলাক্ষ সবিনয়ে বললেন, এই কাল এসেছি।
কাল? কটার গাড়িতে?
বিকেলের।
বিকেলের! তা উঠেছেন কোথায়? মানে কার বাড়ির অতিথি? আমি তো মশাই এখানের পিঁপড়েটিকে পর্যন্ত চিনি—
কমলাক্ষ হেসে বললেন, হিসেব মতো আমি এখানের সকলেরই অতিথি। কারণ এখানে যখন বহিরাগত। তবে ঠিক অতিথি হিসেবে কারও বাড়ি উঠিনি।
ওঃ, বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন? উইথ ফ্যামিলি তাহলে? তা তারা সঙ্গে নেই যে? নেবেন, সঙ্গে নেবেন, বেড়াবার জন্যেই তো আসা। তা কার বাড়ি ভাড়া নিলেন? মানে কোন বাড়িটা? বাড়ির নাম বললেই বুঝব। আমার তো এখানের সবই নখদর্পণে।
কমলাক্ষ হেসে ফেলে বলেন, আপনার প্রশ্নগুলির একে একে উত্তর দিতে হলে বলতে হয়, বাড়ি ভাড়া নিইনি, উইথ ফ্যামিলি নয়, কাজেই তাদের সঙ্গে নেবার প্রশ্ন নেই। যে-বাড়িতে উঠেছি, তার নাম হচ্ছে প্রবাস আবাস–
প্রবাস আবাস! অ!
ভদ্রলোক নাক কেঁচকালেন। তা কলকাতা থেকেই ব্যবস্থা করে এসেছিলেন বুঝি?
কলকাতা থেকে কোনো ব্যবস্থা করে এসেছিলেন সেকথা আর বিশদ বলতে বাসনা হল না। কমলাক্ষর। বোকামির কথা—কেই বা ফাস করতে চায়? তাছাড়া কমলাক্ষ তো কথা কমই বলেন। বেশি কথা বলা তো স্বভাবই নয়। শুধু হঠাৎ এই অতিভাষী ভদ্রলোকের আকস্মিক আক্রমণে, আর বোধ করি পরিচিতি পরিবেশের অভ্যস্ত জীবনধারার বাইরে বলেই এতগুলো কথা একসঙ্গে বললেন।