বিছানা আমার সঙ্গেই আছে। বলেছিলেন কমলাক্ষ। ঈষৎ চিন্তাভাবনার মাঝখান থেকে।
কি বলল লোকটা? মায়ের।
মা আবার কী বস্তু? হোটেলওয়ালীর হোটেল না কি? তা হলেই তো বিপদ গুরুতর। কিন্তু ও যে মা না কি বললে—এটুকু জিজ্ঞেস করতেও লজ্জা করল। বিছানার খবরে হৃষ্ট করুণাপদ বলল, বিছানা আছে? তবে আর কি! চলুন। ঘর দেখিয়ে দিই, জল তুলে দিই, হাত পা মুখ ধোবেন তো? বাবু একটু বেরিয়েছেন, এখুনি এসে যাবেন।
বাবু! তবু ভালো!
কমলাক্ষ ভাবলেন, তবু এবারের যাত্রাটাই দেখছি অযাত্রা। এর থেকে বরাবরের মতো ছুটির দুচারটে দিন পুরী-টুরিতে কাটিয়ে এলেই হত। বেশি লোভ করতে গিয়ে দেখছি সবটাই লোকসান।
কর্তাটি আবার অনুপস্থিত। সে লোককে একবার দেখলেও তবু হোটেলের পদমর্যাদা সম্পর্কে একটু অবহিত হওয়া যেত। অবিশ্যি চাকরটা খুব খারাপ নয়। এর অনুপাতে কর্তা হলে ভালোই হবে আশা করা যায়।
আচ্ছা তা এইটুকু তো বাড়ি। এর মধ্যে আবার হোটেলের ব্যবসা চলে কি করে? নিজেরাও তো থাকে।
ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলেন নির্দিষ্ট ঘরে। বাড়ির ভিতরকার দালান দিয়ে গিয়ে পিছন দিকে খানতিনেক ঘর, বাড়ির সঙ্গে ঠিক লাগোয়া নয়, একটু ছাড়া। এই তিনটি নিয়েই তা হলে হোটেলের লপচপানি!
করুণাপদ বোধ করি মুখের ভাষা পাঠ করতে পারে। তাই বিনীত কণ্ঠে বলে, হোটেল বলতে তেমন কিছু নয় বাবু, ওই বলতে হয় তাই বলা। হোটেল না বললে এখানকার হতচ্ছাড়া লোকগুলো যে বুঝতেই পারে না। রিকশাওলা বলুন, মুটে বলুন, দাই মালি যা বলুন, ওই হোটেল বললেই বোঝে ভালো। তাই পুরনো নাম উঠিয়ে দিয়ে এই প্রবাস বোর্ডিং নাম দেওয়া। নইলে সাইনবোর্ড উলটে দেখবেন, ওপিঠে লেখা আছে প্রবাস-আবাস। মায়ের নিজের দেওয়া নাম। যাক সেকথা বাবু, নামে আর কি করে! থেকে দেখুন ব্যবস্থা কেমন!…দেখুন মা-বাবু কেমন লোক!…মানে ব্যবসাদার তো আর নয়, নেহাত চলে না বলেই তাই।
কমলাক্ষর এবার আর বুঝতে অসুবিধে হয় না।
কর্তা গিন্নি (খুব সম্ভবত নিঃসন্তান) দুজনে এই পরবাস আবাসে বাস করেন, এবং ওই তিনখানি ঘর থেকেই কিছু আয়-টায় করে চালান।
তা মন্দ নয়। নেহাত হোটেল হোটেল হবে না। তবে বেশি গায়ে-পড়া আত্মীয়তা না করতে এলেই হল।
বাকি ঘর দুখানা তো খালিই রয়েছে মনে হচ্ছে, তালা ঝুলছে দেখা যাচ্ছে। কেউ নেই, নাকি তালা দিয়ে বেড়াতে গেছে। ওঃ না, চাকরটা যে বলল এসময় কেউ আসে না, যাক বাঁচা গেছে।
যেরকমটি ইচ্ছে করেছিলেন কমলাক্ষ, সেই রকমটিই জুটে গেল বোধ হয়। বরং বাড়তি কিছু ভালোই হল।
ভাড়াটে বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার ঝামেলা নিজে নিতে হত। যত সংক্ষেপেই করো হতই কিছু ঝাট। চাকর একটা খুঁজতে হত, কে জানে সে ব্যাটা সব ছিষ্টি চক্ষুদান করে পালাতে কিনা, এ তবু একটা গেরস্থ বাড়ির মধ্যে।
বাড়ির মধ্যে ঢুকে এসে আর সেই গা ছমছমানি ভাবটা থাকে না। ভিতরে একটা জোরালো আলো জ্বলছে, আর দালানের দৃশ্য-সজ্জায় একটি গৃহস্থ ঘরের চেহারা পরিস্ফুট হচ্ছে।
এক কোণে জলচৌকীর ওপর ঝকঝকে মাজা বাসন, টুলের ওপর গেলাস ঢাকা দেওয়া জলের কুঁজো, দেয়ালে লাগানো ব্রাকেট আলনায় কিছু জামাকাপড়।
না, শাড়ি নয় অবশ্য। ধুতি শার্ট এই সব তবু সবটা মিলিয়ে একটা লক্ষ্মীশ্রী।
এই আপনার ঘর বাবু। এইটাই হল গে সর্বাপেক্ষা উত্তম। মানে পূব দক্ষিণ দুদিক পাচ্ছেন।
সর্বাপেক্ষা উত্তম শুনে মৃদু হেসে বলেন কমলাক্ষ, তা সর্বাপেক্ষা উত্তমটি আমাকে দিয়ে দিচ্ছ, তোমাদের অন্য খদ্দের এলে রাগ করবে না?
রাগ? রাগ মানে? করুণাপদ উদ্দীপ্ত স্বরে বলে, অগ্রে যে আসবে তারই অগ্রভাগ। এই হচ্ছে জগতেব আইন। তা ছাড়া সে ভয় কিছু নেই বাবু। বললাম তো এ-সময় কেউ আসে না। যা ভিড় ওই আপনার পুজো থেকে শীতকালটি অবধি। বাকি বছর প্রায় বন্ধই পড়ে থাকে।…দাঁড়ান, আপনার হোল্ডঅল খুলে বিছানা বিছিয়ে দেই।
থাক থাক্ করে উঠেছিলেন কমলাক্ষ। বলেছিলেন, অত কিছুতে দরকার নেই, বিছানা তিনি হোল্ডঅল খুলে নিয়ে পেতে নেবেন। এখন শুধু একটু জলের দরকার।
করুণাপদ ছাড়েনি। বলেছিল, জল তো দেবই, চলুন না গোসলখানায়! তা বলে বিছানা আপনি নিজেই পেতে নেবেন? বলেন কি?
হোল্ডঅল খুলে পরিপাটি করে বিছানা পেতে দিয়ে আলনায় তোয়ালে ঝুলিয়ে রেখে চলে গিয়েছিল সে জল দিতে।
সেই অবসরে ঘরটাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখে নিয়েছিলেন কমলাক্ষ। ঘরটি ভালোই। বেশ শুকনো পরিষ্কার, ধুলোশূন্যই বটে। চৌকিটি মজবুত পালিশ করা, আলটি সভ্যভব্য। ঘরের এক কোণে ছোট্ট একখানি টেবিল, আর একখানি কাঠের চেয়ার।
তা হোক। কাঠের হোক। আস্ত মজবুত। সেই ভাড়াটে বাড়িটার ফার্নিচারের দৃশ্য স্মরণ করে আর একবার মনে মনে হাসলেন কমলাক্ষ।
যাক, ভগবান যা করেন ভালোর জন্যেই। বন্ধ করা জানলাগুলো খুলে দিলেন কমলাক্ষ। পাশে একট জানলা থেকে কুয়োর পাড়টা দেখা যাচ্ছে। বাকি সারি সারি তিনটে জানলা পিছনের খোলা জমির দিকে। এই দিকটাই দেখছি দক্ষিণ। বাঃ! আজ অন্ধকার, কিন্তু যেদিন চঁদ উঠবে, রাত্তির বেলা জানলা খুলে শুতে বড়ো চমৎকার লাগবে তো! অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন কমলাক্ষ। অন্যমনস্ ২য় সেই অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
একটা অননুভূত অনুভূতিতে মনটা কেমন আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে।