কমলাক্ষ চোখ নামালেন। একটু বেশিক্ষণ চেয়ে থাকা হল মনে হচ্ছে।
মহিলাটি অবশ্য কমলাক্ষর ওই দৃষ্টি আর দৃষ্টি নামানোর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন না। নিতান্ত সহজভাবেই উত্তরটা দিলেন, তা ছাড়া আর কোনো উপায়ও তো দেখছি না। শ্মশান শুনেছি এখান থেকে বেশি দূর নয়। আমি আছি, করুণাপদ আছে, আর প্রায় স্পষ্টই হেসে উঠল ও এবার, আর আপনি তো আছেনই। আপনি তো আর চলে যেতে পারছেন না? তিনজন মিলে যা-তোক করে
আচ্ছা আপনাদের এখানের লোকগুলো কী কমলাক্ষ এবার বিস্ময়ের সঙ্গে একটু বিরক্তি প্রকাশ না করে পারেন না। মানুষ না জানোয়ার? এই রকম একটা বিপদের সময়ও–
এই রকম একটা বিপদই তো এই দীর্ঘকাল ধরে চাইছিল ওরা। চাইছিল অথচ পাচ্ছিল না, কত হতাশায় ছিল! এতদিনে যদি দিন পেয়েছে তার সদ্ব্যবহার করবে না?
কমলাক্ষ একটুক্ষণ থেমে থাকেন। থেমে থেমে বলেন, জানি না এমন একটা অদ্ভুত অবস্থার সৃষ্টি হওয়ার কারণটা কি আপনাদের জানতে চেয়ে বিব্রত করতেও চাই না, শুধু বলছি—আপনার ওই সমস্যা-সমাধানের প্রস্তাবটা বাস্তব নয়। থাক ও নিয়ে আপনি আর মাথা ঘামাবেন না, আমি বেরচ্ছি, যা হয় একটা ব্যবস্থা হবেই। কেবল আপনার ওই করুণাপদকে বলবেন, কোথাও থেকে কিছু ফুল যদি জোগাড় করে আনতে
ফুল! ওঁর জন্যে ফুলের কথা বলছেন?
এতক্ষণের ভাবশূন্য সাদাটে মুখটায় হঠাৎ যেন এক ঝাঁক রক্তকণিকা এসে ভিড় করে দাঁড়ায়, ঠেলাঠেলি করে।
কমলাক্ষ আর একবার চোখ নামান। শান্ত স্বরে বলেন, মৃতকে আর কি দিয়ে সম্মান জানানো যায় বলুন? পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার কালে এইটুকুই তো তার শেষ পাওনা?
.
নাঃ, বাসিন্দা এখানে খুব বেশি নেই। দুচারজন রিটায়ার্ড ভদ্রলোক এদিকে-সেদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। হয়তো বা সস্ত্রীক, হয়তো বা একা। একারা বিপত্নীক কি সংসার-বিদ্বেষী সেকথা বলা শক্ত। অবসর গ্রহণের পর স্ত্রী-পুত্র-সংসারের সঙ্গে কিছুতেই বনে না, এমন লোকের সংখ্যা সংসারে বিরল নয়। হয়তো অমনোমত খাওয়া-দাওয়া নিয়ে হয়তো বা সংসারের খরচ-পত্রের প্রশ্ন নিয়ে। রিটায়ার করলে যে টাকা কমে যায়, সে-সত্যটা মানতে রাজী নয় অনেক মহিলাই।
তেমনি বাড়ির কর্তারা মাঝে মাঝে বেশ কিছুদিন করে বসবাস করে যান এখানে সুসময়ের তৈরি ইটকাঠের আশ্রয়টুকুর মধ্যে।
বাড়িগুলো সারানো আর হয়ে ওঠে না, দেওয়ালগুলো বালি ঝরা, রেলিঙগুলো মরচে ধরা, কার্নিশের কোণ ভাঙা, একদার ফুলবাগান শুকনো আগাছার জঞ্জাল, তবু তার মধ্যেই বেশ কাটান তারা। কোনো একটা যাহোক মতো দেহাতি চাকর জোগাড় করে, তাকে দিয়ে দুবেলা মুরগির ঝোল আর ভাত রাঁধিয়ে ক্ষুগ্নিবৃত্তি করেন, আর লাঠি একগাছা হাতে নিয়ে দুবেলা শহর প্রদক্ষিণ করে বেড়ান। আর সেই সূত্রে শহরে যে যেখানে আছে তাদের নাড়ির আর হাঁড়ির খবর নিয়ে বেড়ান।
অবশ্য এমনটা খুব বেশি সংখ্যায় নেই। সস্ত্রীকই আছেন অনেকে। ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়ে গেছে, যে যার পথ দেখেছে, শেষ জীবন পরস্পরে পরস্পরের আশ্রয় হয়ে মফঃস্বলের বাড়িটিতে এসে বাস করেছেন। তাদের সংসারে অবশ্য লক্ষ্মী, ষষ্ঠী, ইতু, ঘেঁটু থেকে শুরু করে মোচার ঘন্ট, কচুর শাক, গোটাসিদ্ধ পর্যন্ত কিছুরই ত্রুটি নেই। তবে সময়েরও অভাব নেই। তারাও অপরের জীবনের নিভৃতে উঁকি না দিয়ে পারেন না।
না করলে কি নিয়ে থাকবে? কর্মহীন জীবনকে উপভোগ করতে কজন জানে? কজন শিখেছে সে-আর্ট?
তা এ ছাড়া আর যত বাড়ি সবই প্রায় পড়ে থাকে বুকে এক-একটা ভারী তালা ঝুলিয়ে। পাছে জানলা-দরজাগুলো কেউ খুলে নিয়ে যায়, তাই নামকা ওয়াস্তে একটা করে মালি নামধারী ফঁকিবাজ ব্যক্তি থাকে। ছুটিছাটায় কখনও বাড়ির লোকেরা বাড়িতে এলে তবে তাকে বাড়ির ধারে কাছে দেখতে পাওয়া যায়। তখন সে ঘাস চাঁছে ভাঙা বেড়ার দড়ি বাঁধে, দেয়ালের উই ভাঙে।
পুজোয় সময় জায়গাটা ভরে ওঠে, রঙে লাবণ্যে করবে।
প্রবাস বোর্ডিঙেও সে সময় চাঞ্চল্য জাগে। সেই তো মরসুম। নইলে সারা বছরে কে কত চেঞ্জে আসে! কমলাক্ষর মতো কে আসে গরমের ছুটিতে!
তা যারা থাকে, তারা প্রবাস বোর্ডিঙের মালিক মালিকানির সঙ্গে মুখ দেখাদেখি রাখে না কেন, এও তো একরহস্য!
শুধু যে মুখ দেখে না তা নয়, খদ্দেরও ভাঙায়। অন্তত ভাঙাতে চেষ্টা করে। সে-কথা মনে পড়ল কমলাক্ষর পথ চলতে চলতে।
বেশিদিনের কথা তো নয় যে ভুলে যাবেন। মাত্র সাতটা দিন আগেই তো।
পলাশপুর স্টেশনে নেমেছিলেন কমলাক্ষ সুটকেসটা আর বেডিংটা নিয়ে। কলকাতা থেকে একটা বাড়ি মাসখানেকের জন্যে ভাড়ার ব্যবস্থা করে এসেছিলেন, মনটা তাই বড়ো নিশ্চিন্ত আর খুশি-খুশি ছিল। গরমের ছুটির একটা মাস থেকে যাবেন এখানে। সেই একটা মাসে কলেজের খাতা দেখা থাকবে না, ঝামেলা থাকবে না। শুধু খাবেন ঘুমাবেন আর বই পড়বেন।
পড়া তো হয় না। কত ভালো ভালো বই নীরব অভিযোগের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে কমলাক্ষর দিকে, যেন বলতে চায় মলাটটা পর্যন্ত ওলটাবার যদি সময় নেই তোমারি, কেন তবে কিনেছ আমাদের? কেন বন্দী করে রেখেছ তোমার শেলফের খাঁজে খাঁজে?
ওরা ঠিক টের পায় কমলাক্ষর অন্তরাত্মা কতখানি তৃষিত হয়ে থাকে, শুধু মলাট ওলটানো নয়, একেবারে ওদের ঘরের দরজা খুলে অন্তঃপুরে ঢুকে পড়ার জন্যে?