কমলাক্ষ হতাশ গলায় বলেন, আমি তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না করুণাপদ।
করুণাপদ বলে, বুঝতে কি আমিই পেরেছি বাবু? আমাকে ঘুম ভাঙিয়ে বললেন, করুণাপদ দোরটা দে, আমি একটু পুজো দিতে যাব। যত জেরা করি তত বলেন, চুপ চুপ! মানে আর কি আপনার ঘুম ভাঙার ভয়ে—তা এসে যাবেন বোধ হয় বিকেলের মধ্যে। শুনছি আজ যোগ, যাবে অনেকে। মুখটা ধুয়ে নিন বাবু, চায়ের জল চাপিয়েছি।
মুখুজ্জেবাবু না থাকলে যে করুণাপদও সেই অজানা দেবস্থানটা দেখে আসতে পারত সেই কথা ভাবতে ভাবতে যায় করুণাপদ। মানুষটা বড় গোলমেলে।
একমাসের কড়ারে এসেছিল, তার মধ্যে কত কাণ্ডই ঘটে গেল। কাল আবার বাবুর মেয়ে এসে বকাবকি করে গেল। চলে গেলেই হত। করুণাপদ মায়ের তলায় তলায় থেকে হোটেলটা ঠিকই চালিয়ে যেত। উনি আবার এখন কত ফ্যাচাঙের কথা কইছেন। আরে বাবা, আমরা অভিভাবকশূন্য হলাম তা তোর কি? তুই যদি এ-সময় না আসতিস পলাশপুরে?
.
কমলাক্ষ যদি না আসতেন পলাশপুরে? এই সময় নয়, কোনো সময় নয়? জীবনে তো কখনও পলাশপুরের নামও শোনেননি কমলাক্ষ। কোন গ্রহের চক্রান্তে—কিন্তু গ্রহের চক্রান্ত কি কমলাক্ষর? না লীলার?
অদ্ভুত একটা ইতিহাস নিয়ে অদ্ভুত একরকম জীবনযাপন করছিল যে-লীলা এই অখ্যাত অবজ্ঞাত জায়গাটায়? কমলাক্ষই কি তার জীবনে কুগ্রহের মূর্তি নিয়ে এসে দাঁড়ালেন না? কমলাক্ষ না এলে হয়তো ব্ৰজেন ঘোষ টিকে থাকত। হয়তো তাহলে লীলা তাকে মদ খাবার পয়সা দিত।
হয়তো বাড়িতে একটা ভদ্রলোক রয়েছে বলেই ব্রজেন ঘোষকে শাসন করতে গিয়েছিল লীলা। কমলাক্ষ না এলে হয়তো এসব কিছুই হত না।
আর কমলাক্ষর নিজের? এখানে না এলে কমলাক্ষই কি জীবনে কখনও জানতে পারতেন জীবনের সত্য কি?
চিঠিখানা আর একবার চোখের সামনে তুলে ধরলেন কমলাক্ষ। চিঠি নয়, কাগজের একটু টুকরো। যে টুকরোটুকু কমলাক্ষর মশারির তলায় গোঁজা ছিল।
মিথ্যে একটা বন্ধনে জড়িত হয়ে জীবনকে জটিল করে তুলবেন না। চলে যান, দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে। ভগবানের বিধানে কত শত বন্ধন মুহূর্তে ছিঁড়ে পড়ে, তাও তো সহ্য করে নিতে হয় মানুষকে? এও না হয় সেইরকমই মনে করুন। মানুষের গড়া সমাজও তো দ্বিতীয় ভগবান!
ভাববেন না-প্রবাসে আবাস আবার চলবে পুরনো নিয়মে। খদ্দেররা যথারীতিই যত্ন পাবে, অনুষ্ঠানের ত্রুটি হবে না। আর আমাকে দেখা-শোনা? তাতেও নিশ্চিন্ত করেই রাখি। শুনুন, যদি শরণ নিই তা হলে ওই গগন গাঙ্গুলীরাই দেখবেন। তাই নেওয়াই ভালো নয় কি?
তাইতো আমাদের দ্বিতীয় ভগবানের নিয়ম। বেরোবার সময়টা পালিয়ে প্রাণ বাঁচাচ্ছি, তাতে ভীরু বলুন আর যাই বলুন। আজই কিন্তু চলে যাওয়া চাই। আর শুনুন—মনে করবেন না কিছু, ছুটিছাটা হলে আর যেন ভুলে কখনও পলাশপুরের টিকিট কেটে বসবেন না।