চলে যেতে উদ্যত সোমা ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজাটা শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে বলে, বেশ, তবে তাই বোঝন।
কমলাক্ষ মাথা নেড়ে বলেন, আর হয় না। তুমি বোধ করি ফিরে গিয়ে তোমার শ্বশুরবাড়িতেই উঠবে? যদি তা না ওঠো, তো বলে রাখি—আমি কাল ফিরব। আর ওই ভদ্রমহিলা যাবেন আমার সঙ্গে।
.
এ আপনি কী করলেন?লীলা রুদ্ধস্বরে প্রশ্ন করে।
কমলাক্ষ আস্তে বলেন, ঠিকই করলাম।
আর আপনার ঠিকের সঙ্গে যদি আমার ঠিক না মেলে?
কমলাক্ষ সেই সাধারণ—একেবারে সাধারণ শীর্ণ মুখটার দিকে চুপ করে তাকিয়ে থেকে তারপর বলেন, মেলাতেই হবে যে–
লীলা সহসা ভিন্ন মূর্তি নেয়। রুক্ষস্বরে বলে, কিন্তু কেন বলুন তো? আমি আমার নিজের ব্যবসা নিয়ে নিজের জীবন নিয়ে পড়ে আছি, পড়ে থাকব। আপনার কী দরকার ভাবতে বসার—আমার অভিভাবক আছে কি না। আপনি কে? আপনার সর্দারী আমি নেবই বা কেন? যান আপনি কলকাতায় ফিরে যান আপনার মেয়ের সঙ্গে। এখনও ট্রেন ছাড়েনি, এখনও উপায় আছে।
কমলাক্ষ মৃদু হেসে বলেন, না আর উপায় নেই।
.
উপায় নেই। আর উপায় নেই।
কিন্তু লীলা কি পারবে না উপায় বার করতে? লীলা কি সম্মানের চাইতে সুখকে অধিক মূল্য দেবে? যে-স্বর্গে অধিকার নেই, সে-স্বর্গ শুধু দৈবাৎ হাতের মুঠোর কাছে এসে পড়েছে বলেই তাকে মুঠোয় চেপে ধরবে?
আর হতভাগা ব্রজেন ঘোষ? তাকে শুধু করুণাই করবে লীলা? সম্মান করবে না? সে তার জীবনপাত করে যে-আশ্রয় রচনা করে দিয়ে গেছে লীলার জন্যে, লীলা সে-আশ্রয়কে ভাঙা মাটির বাসনের মতো ফেলে দিয়ে চলে যাবে?
নাঃ, তা হয় না। লীলার সুখের মূল্যে অনেকগুলো সম্মান বিকিয়ে যাচ্ছিল, তা যেতে দেবে না লীলা। ব্ৰজেন ঘোষের সম্মান রক্ষা পাক, রক্ষা পাক কমলাক্ষর পরিচয়ের সম্মান, কমলাক্ষর সন্তানদের আর সংসারের সম্মান।
আর লীলার? না, তার আগে কিছুই রইল না। না সুখ, না সম্মান।
রইল শুধু ভাগ্যের তীক্ষ্ণ ধিক্কার! সে মুখ বাঁকিয়ে বলবে, ছি ছি! হীরের কৌটো এগিয়ে ধরলাম তোর দিকে, আর তুই হাত পিছিয়ে নিয়ে ভাঙা কাঁচের টুকরো খুঁইয়ে আঁচলে বাঁধলি?
তাছাড়া? আরও এটা তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ অহরহ বিকৃত করবে না লীলাকে? বলবে না ভীরু! ভীরু! বলবে না—সাহস দেখে সাহস হল না তোমার?
না, সাহস দেখে সাহস হল না লীলার। ভয় করল।
অথচ লীলা তো ভীরু ছিল না লীলার সাহস দেখে লোকে অবাক হত। লীলাকে কে ভাঙল? কে এমন দুর্বল করে দিল? তাই পালিয়ে গিয়ে সমস্যার সমাধান করতে বসেছে লীলা। সমাধানের আর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না।
.
করুণাপদ ঘুম ভেঙে উঠে চোখ মুছতে মুছতে বলে, সে কি মা, এই মাঝরাত্তিরে আবার তুমি কোথায় পুজো দিতে যাবে?
যাব রে যাব—। লীলা চুপি চুপি বলে, সে একটা দেবস্থান আছে, একেবারে উষাভোরে পুজো দিতে হয়। এখন থেকে না বেরোলে—দূর তো অনেকটাই—
তা সাতজন্মে তো তোমায় এমন উন্মাদ হয়ে দেবস্থান দেখতে যেতে দেখিনি মা? হঠাৎ আবার কি হল তোমার?
লীলা বলে, চুপ আস্তে আস্তে। মুখুজ্জেবাবুর ঘুম ভেঙে যাবে। পুজো দিচ্ছি—তোর অসুখের সময় মানসিক করেছিলাম বলে। যাক, তুই দোরটা দে।
করুণাপদ কাতর কণ্ঠে বলে, আমার আবার অসুখ, তার আবার মানসিক! আমি একটা মনিষ্যি! তা কাল আমায় কিছু বললে না—এখন হঠাৎ রাত না পোয়াতে বলছ, দোর দে, আমি যাই। একা যাবে তুমি? তাই কখনও হয়?
লীলা ব্যস্তভাবে বলে, হয় হয় খুব হয়। আজ যোগ যে! কত লোক যাচ্ছে! তুই সুন্ধু চলে গেলে মুখুজ্জেবাবুর খাওয়া-দাওয়ার কী হবে? ভাবছিস কেন? মরে যাব? এত কাণ্ডতেও যখন তোর মা ঠিক অটুট থাকল করুণাপদ, তখন একা দেবস্থানে যেতে মরে যাবে না। দে তুই দোর দে। দিয়ে আরও খানিক শুগে যা। এখনও ফরসা হতে দেরি আছে। মানসিক শুধতে যাচ্ছি, বাধা দিসনে। পিছু ডাকলে দোষ হয়।
তা বেশ, ডাকছি না। ফিরবে কখন সেটা শুনি?
ওই যেতে আসতে যা সময় লাগবে! সিল্কের চাদরখানা গায়ে জড়িয়ে অস্ফুট আলোর চাদর গায়ে দেওয়া রাস্তায় হন হন করে এগিয়ে চলে লীলা।
যতক্ষণ দেখা যায় তাকিয়ে থেকে, আস্তে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে বসে করুণাপদ। দেবদ্বিজে এত ভক্তি আর কবে দেখেছে লীলার?
এই লক্ষ্মীছাড়া করুণাপদর এতখানি মূল্য? তার অসুখে মানসিক করতে হয়, আবার সে-মানসিক শোধ করতে লীলাকে যেতে হয় ঊষাভোরে পায়ে হেঁটে?
চোখে জল এল করুণাপদর।
.
অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলেন কমলাক্ষ। চোখে ঘুম এল প্রায় শেষ রাত্রে। এল তো বড়ো গভীরই এল।
ভোর রাত্তিরের ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া হু হু করে বয়ে চলেছিল ঘরের মশারি উড়িয়ে, আলনায় ঝোলানো জামাকাপড় দুলিয়ে।
রাত্রিজাগা ক্লান্ত দেহে এ হাওয়া যেন একটা নেশার জাদু বুলিয়ে দিল। সে-নেশার আচ্ছন্নতা কাটতে রোদ উঠে গেল সকালের।
করুণাপদর ডাকেই বোধ হয় ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন। দেখলেন গলানো রুপোর স্রোত ঘরের মেঝেয়, বিছানায়, মশারিতে, মাঠে আকাশে।
বললেন, সর্বনাশ! কত বেলা!
করুণাপদ বলল, হ্যাঁ, বেলা দেখেই ডেকে দিলাম বাবু। মা বাড়ি নেই, আপনিও ঘুমোচ্ছেন, প্রাণটা কেমন করতে লাগল। তাই বলি ডেকে দিই–
কমলাক্ষ অবাক হয়ে বললেন, মা বাড়ি নেই!
আজ্ঞে না। সেই শেষ রাত্তিরে উঠে দেবস্থান গেছেন মানসিক শুধতে। কপাল করুণাপদর! তার জীবন আবার জীবন! তার সেই জীবনের জন্যে মানসিক করা, তার জন্যে ক্লেশ স্বীকার করে যাওয়া–