বিশেষ বলছেন কেন বুঝছি না।
ওঃ তা বটে। তোকে আদৌ দেওয়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু জানিস তো চিঠিপত্রের ব্যাপারে আমি চিরদিনের কুঁড়ে।
কমলাক্ষ ভাবলেন, তবে কি যা ভাবছিলাম তা নয়। শুধু অভিমান? চিঠি দিইনি, ফেরার দিন ফিরিনি, তাই রাগে দুঃখে–
সোমা হাত তুলে ঘড়ি দেখে বোধ করি নতুন হাতিয়ার সংগ্রহ করবার আগে অবহিত হতে চায় হাতে কতটা সময়।
ওর ওই ঘড়ি দেখার মুহূর্তে ঘড়ির ওপর ছায়া পড়ে। আর সেই ছায়া কথা কয়ে ওঠে, শরবৎটা ফেরত দিলে কেন? খাও না বুঝি? তা হলে একটু চা–
সোমা বিদ্যুৎবেগে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আমাকে তুমি বলবার অধিকার আপনাকে কে দিল শুনতে পেতে পারি?
কমলাক্ষ চমকে উঠলেন। কমলাক্ষ আপন আত্মজার অসভ্যতায় লাল হয়ে উঠলেন। কিন্তু লীলার মধ্যে ভাবান্তর দেখা গেল না। সে শুধু উত্তরটা দিল। সহজ ভাবেই দিল। অধিকার কি আর হাতে করে কেউ তুলে দেয়? তা ধর যদি কেউ দিয়েই থাকে, আমার বয়েসই দিয়েছে।
সোমা কিন্তু ঠিক এমন উত্তরটা আশা করেনি। তাই সোমা এর আগে যার দিকে তাকিয়ে দেখবার প্রবৃত্তি খুঁজে পায়নি—তার দিকে এখন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে? কিন্তু তাকিয়ে দেখে সোমা হতাশ হচ্ছে নাকি? বিতৃষ্ণ হচ্ছে?
ওর চোখে মুখে কি এই প্রশ্নই ফুটে উঠছে না—এই! এই একেবারে সাধারণের সাধারণ। না রং, না গড়ন, না মুখশ্রী, এর মধ্যে আকর্ষণীয় কি আছে? যে-আকর্ষণ পাহাড় টলায়?
তবে কি সোমাকে কেউ বোকা বানিয়েছে, কুৎসিত একটা কৌতুক সৃষ্টি করে? আর বোকা সোমা সেই কৌতুকের তালে নেচে-কিন্তু তাই কি? বাবার আচরণ, বাবার চেহারা, কোন্ পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছে?
না, সোমা বাবার মুখের সাক্ষ্যই নেবে। তাই সামনের মানুষটার দিকে তীব্র দৃষ্টি হেনে বললে, ওঃ বয়েস! মফঃস্বলের দিকে সেই রকম একটা হিসেব ধরা হয়ে থাকে বটে। যাক কষ্ট করে আর
আপনাকে শরবতের বদলে চা করতে হবে না। আমি এখানে খেতে আসিনি।
আশ্চর্য! আমিই কি তা বলছি? তবু ছেলেমানুষ—রোদে এসেছ—
থাক, এত স্নেহ প্রকাশের দরকার নেই। দয়া করে বারে বারে এসে ব্যাঘাত ঘটাবেন না। আমাকে আমার বাবার সঙ্গে কথা বলতে দিন একটু।
লীলাও তাহলে সোমার মতোই পাথর! তাই এ-কথার পর অপমানে বিবর্ণ হয়ে সরে না গিয়ে সহজেই বলতে পারল কি করে, কিন্তু ওঁর যে এখন খাওয়ার সময় হয়েছে!
ওঃ! সময় হয়ে গেছে! বাবা, আপনি তাহলে খুব যত্নটত্ন পাচ্ছেন। তাই বুঝি আর নিজের সংসারে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না? সত্যি সেখানে আর কে কখন ঘড়ি ধরে খাওয়াচ্ছে! কিন্তু আজ হয় সময়টা একটু উত্তীর্ণই হল।
কমলাক্ষ বিচলিত হন, চঞ্চল হন, উত্তেজিত হন। আর সেই তিনটে অবস্থা একটা স্বরের মধ্যে ফেলে বলে ওঠেন, সোমা, পাগলামীরও একটা সীমা আছে।
সোমা কিছু উত্তর দিত কিনা কে জানে। তার আগেই লীলা শান্ত গলায় বলে, মিস্টার মুখার্জি, আপনার মেয়েকে একটু বুঝিয়ে দিন, এটা বাড়ি নয়, হোটেল। এখানে খাওয়া-দাওয়ার একটা নির্দিষ্ট টাইম থাকে, আর সেটা মেনে চলতে হয়।
লীলা চলে যাবার পর কমলাক্ষ বলেন, সোমা তুমি তাহলে ঝগড়া করবে বলেই কোমর বেঁধে এসেছে? জানি না কেন তোমার এ-দুর্মতি হয়েছে, কিন্তু
জানেন না? কেন তা জানেন না? সোমা বিদ্যুতের দ্রুততায় হাতের ভ্যানিটিটা খুলে একখানা চিঠি বার করে বাপের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, এই চিঠিটা আপনি অস্বীকার করতে পারেন?
চিঠিটা কি বাবদ, কার লেখা এসব প্রশ্ন না করে হাত বাড়িয়ে নিয়ে খুলে চোখের সামনে তুলেই ধরেন কমলাক্ষ। আর মিনিট খানেক চোখ বুলিয়েই সেটা ঠেলে সরিয়ে রেখে সোমার চোখে চোখ ফেলে বলেন, তোমার বাপের নামে কুৎসা করা একটা উড়ো চিঠি তোমাকে এতটা বিচলিত করে তুলেছে এটা আশ্চর্য।
শুধু চিঠি? সোমা তীব্র স্বরে বলে, নিজের চক্ষে দেখলাম না আমি? প্রমাণ পেলাম। আপনি গুরুজন, তবু মুখের ওপরেই বলব, আপনার বয়সের কথা ভেবে আর রুচির চেহারা দেখে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে আমার। তবু আপনার কাছে হাতজোড় করছি বাবা, আপনি এই আবেষ্টন থেকে চলুন।
কমলাক্ষও বুঝি ওদের মতো হয়ে যাচ্ছেন। তাই মেয়ের কাছ থেকে অতখানি অপমান পেয়েও গায়ে মাখলেন না। উল্টে হেসে উঠে বললেন, আমার কাছে হাতজোড় করবে, সেটা আর বাহুল্য কি? আমি তাতে কুণ্ঠিতও হব না। কিন্তু আমি কলকাতায় যাব না, একেবারে চিরকালের মতো এইখানেই থেকে যাব, এমন অদ্ভুত ভয়ে কাতর হবার মানে কি তাই ভাবছি।
বেশ, যাবেন তো আজই চলুন।
তা কি হয়?
তা হয় না?
না। ছুটি শেষ হবার পরও যখন থাকতে হয়েছে—ধরে নাও বিশেষ কোনো কাজে আটকে পড়েছি।
সোমা ছিটকে ওঠে। সোমা চটির মধ্যে পা গলায়। তীব্র স্বরে বলে, আটকে পড়েছেন যে কিসে সে তো চোখের সামনে দেখতেই পেলাম। কিন্তু জীবনে কখনও ধারণা করিনি, আপনি আমাদের মাকে এইভাবে অপমান করবেন।
সোমা, সংযত হয়ে কথা কও।
না কইব না। কইতে পারছি না। বাবা- সোমার ফেটে পড়া রাগ সহসা ফুটন্ত জল হয়ে চোখের স্নায়ুগুলো পুড়িয়ে দেয়, আপনার ছেলে, আপনার মেয়ে, আপনার সংসারের পবিত্রতা, সব কিছুর চেয়ে বড় হল ওই বিশ্রী–
ও বেরিয়ে যাচ্ছিল। কমলাক্ষ ওর ওই ক্রুদ্ধা নাগিনীর মূর্তির দিকে মুহূর্তকাল স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থেকে বলেন, তুমি যদি বিচারকের পোস্ট নিয়ে না আসতে সোমা, হয়তো তোমার এই প্রশ্নের উত্তর দিতাম। হয়তো তখন আর তোমার বোঝা শক্ত হত না কোষ্টা বড়ো কোন্টা ছোটো। অভিযোগ করে বসতে না তোমাদের মাকে আমি অপমান করছি।