কমলাক্ষর মুখ তাঁর মেয়ের মতো অমসৃণ নয়, পাথুরেও নয়, তবু এখন যেন পাথর পাথরই লাগছে। হঠাৎ এভাবে তোমার আসার কারণ কি সোমা?
কারণটা আপনি নিজেই নির্ণয় করুন বাবা!
নির্ণয় করা শক্ত হচ্ছে বলেই তো জিগ্যেস করছি। ষোলো তারিখে আমার যাবার কথা ছিল, আর আজ মাত্র আঠারো তারিখ, এই দু-দিনেই তুমি এত অস্থির হয়ে উঠলে যে—তা ছাড়া আমি টেলিগ্রামও করেছি।
করেছেন। কিন্তু যেতে না পারার কারণ কিছু দর্শাননি।
কমলাক্ষ গম্ভীর হয়ে গেছেন। দৃঢ় হয়ে গেছেন। বললেন, কারণ দর্শাতে হবে, সেটা অনুমান করিনি। যেতে পারলাম না, সেটাই কি যথেষ্ট নয়?
না নয়! আপনার ভাবা উচিত ছিল, আমরা দুশ্চিন্তায় পড়তে পারি। ধরে নিতে পারি আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন
ইচ্ছে করলে অবিশ্যি সবই পার। কিন্তু চিন্তাকে অতদূর না পাঠালেও পারতে সোমা! সব কিছুরই একটা মাত্রা থাকা দরকার।
দরকার! মাত্র থাকা দরকার। তাই না বাবা? কিন্তু সেটা কি শুধু ছোটোদের বেলা? বড়োরা মাত্রাছাড়া যা খুশি করলেও দোষ নেই?
কমলাক্ষ গম্ভীর হলেন। সোমা তুমি তো জান ছেলেমেয়েদের তিরস্কার করা আমি পছন্দ করি। তাছাড়া তুমি বড়ো হয়েছ।
সোমা বাপের এই সামান্যতম ইঙ্গিতে থামে না। তেমন অভিমানী প্রকৃতির মেয়ে হলে, এই দুঃসাহসিক অভিযানের পথে পা বাড়াত না সে। তাই ইঙ্গিত গায়ে না মেখে বরং নিজের ভঙ্গিতেই আরও অগ্রাহ্যের ভাব আনে।
বড়ো হয়েছি বলেই ছোটোর মতো মুখ বুজে অন্যায় মেনে নেওয়া শক্ত হল বাবা! হাল ধরতেই হল। আমি এসেছি, ফিরতি ট্রেনেই যাব, আপনাকে নিয়ে যাব।
আমাকে নিয়ে যাবে? সহসা হেসে ওঠেন কমলাক্ষ, নিয়ে যাবে কি বল? আমি কি ছেলেমানুষ শিশু, যে তুমি সঙ্গে করে নিয়ে যাবে?
সোমার সেই বাটালির দাগ-থেকে-যাওয়া মুখটা আর একটু অমসৃণ দেখায়। সোমার গলার স্বর প্রায় ধাতব হয়ে ওঠে। বুড়োমানুষরা যখন ছেলেমানুষী করে, সেটা আরও বেশি অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে বাবা, আর তখন তাদের ওপর জোর ফলানো ছাড়া উপায় থাকে না। আমি বলছি আমার সঙ্গে আপনাকে যেতেই হবে। কোথায় আপনার জিনিসপত্র? দেখিয়ে দিন গুছিয়ে নিই।
সোমা ঘরের এদিক-ওদিক তাকায়।
কিন্তু কমলাক্ষ সে ভঙ্গিকে আমল দেন না। শান্ত আর নরম গলায় বলেন, তুমিও বড়ো হয়েছ। সোমা, তোমাকেও আর ছেলেমানুষী মানায় না। একা এসেছ তুমি? না সঙ্গে কেউ আছে?
বৃন্দাবন আছে। তাকে স্টেশনে বসিয়ে রেখে এসেছি।
বিরস ভারী গলায় কথা বলছে সোমা। মনে হচ্ছে, যেন একটা গিন্নি। বুদ্ধিটাও তার গিন্নিদেরই মতো। বৃন্দাবন ওর বাড়ির চাকর। তার সামনে পাছে কোনো দৃশ্যের অবতারণা হয়, তাই তাকে স্টেশনে বসিয়ে রেখে এসেছে।
অতএব দৃশ্যের অবতারণা করে চলে। বিদ্রুপে মুখ কুচকে বাপের মুখের ওপর বলে চলে, আপনি তাহলে কি ঠিক করেছেন? সংসার ত্যাগ করবেন?
সোমা, অসভ্যর মতো কথা বোলো না।
সোমার বুক কাঁপে না। সোমা জাহাবাজ। সোমা তার মায়ের প্রকৃতি পেয়েছে। যে মা তাকে তিন বছরের রেখে মারা গেছে। হ্যাঁ, নীরজাও এমনি জবরদস্ত প্রকৃতির ছিল। অতটুকু বয়সেই
সে-পরিচয় রেখে গিয়েছিল সে।
তাই সোমা বলে, সংসারের সর্বত্র যদি সভ্যতা বজায় থাকে, তা হলে কাউকেই অসভ্য হবার দুঃখ পেতে হয় না বাবা! আপনি যদি–
কথার মাঝখানে করুণাপদ এক গ্লাস চিনির শরবৎ নিয়ে এসে দাঁড়ায়। এবং সাহসে ভর করে এগিয়েও ধরে সোমার দিকে।
সোমা একবার কুলিশ কঠোর দৃষ্টিতে তার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে কঠিন স্বরে বলে, দরকার লাগবে না, নিয়ে যাও।
করুণাপদের হাত কেঁপে খানিকটা শরবৎ চলকে মাটিতে পড়ে, করুণাপদ পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়।
কমলাক্ষ ক্ষুব্ধ হেসে বলেন, ছেলেমানুষীতে তো কেউ কম যায় না। রোদে ট্রেনে এসেছ, ওটা খেলেই পারতে।
খাবার মতো মনের অবস্থা থাকলে ঠিকই খেতাম। সে যাক আপনি আমার কথার উত্তরটা কিন্তু দেননি।
কোন কথার? কমলাক্ষ অন্যমনস্ক হয়ে গেছেন। কমলাক্ষ জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছেন প্রখর দুপুরের আকাশে উড়ন্ত এটা নিঃসঙ্গ চিলের দিকে। চিলটা অবিরত একই বৃত্তে পাক খাচ্ছে।
আশ্চর্য তো! কিন্তু কেন? মানুষের মতো ওরাও কি আপন হাতে বৃত্ত রচনা করে শুধু সেই পথেই পাক খায়? ওদের তো ডানা আছে, ওদের এ-দুর্মতি কেন? আবার ভাবলেন মানুষেরও একদিন ডানা ছিল। সে-ডানা মানুষ নিজেই ভেঙেছে। মানুষ আকাশ হারিয়েছে, কিন্তু তার বদলে কতটা মাটি পেয়েছে?
ভাবছিলেন, তাই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। তাই বলেন, কোন্ কথার?।
সোমা দাঁতে ঠোঁট চেপে ঠোঁটের রঙের অনেকখানি ঘুচিয়ে ফেলে দাঁতে-চাপা স্বরে বলে, আপনি কলকাতায় ফিরবেন কি না, সেই প্রশ্নটার উত্তর পাইনি।
কলকাতায় ফিরব কি না! কমলাক্ষ অবাক গলায় বলেন, এটা একটা প্রশ্ন হল?
ধরুন ওইটাই আমার প্রশ্ন?
কিন্তু ফিরব কি না এমন অদ্ভুত প্রশ্ন তুমি তুলবেই বা কেন? কলকাতায় ফিরব না? আমার কলেজ নেই?
এবার সোমার সেই পাথুরে মুখে এতটুকু একটু অভিমানের কোমলতা এসে লাগে। কি জানি আপনার কি আছে, আর কি নেই। অন্তত এই ছত্রিশ দিনের মধ্যে আপনার মনে ছিল না, আপনার একটা ছেলে আছে, একটা মেয়ে আছে, তাদের মা নেই।
কমলাক্ষ মৃদু হাসেন। বলেন, ছেলেমেয়েদের মা নেইটা এত তামাদি হয়ে গেছে সোমা, যে সত্যিই মনে থাকে না। কিন্তু ছেলেমেয়েরা আছে এটা ভুলে যাচ্ছি, এতদূর ভাবতে বসেছিস কেন বল তো? চিঠিপত্র বিশেষ দিইনি বলে?