তিনি গগন গাঙুলী, তাঁর নাকে দড়ি পরিয়ে ঘুরিয়েছে ওরা! সেই অবধি খদ্দের ভাগানোই পেশা করেছেন।
তা এ-যুগে লোক খুব একটা বিচলিত হয় না ওতে। স্বামী-স্ত্রী নয়, তবু স্বামী-স্ত্রী সেজে ব্যবসা চালাচ্ছে—এ এমন একটা কিছু নতুন কথা নয়।
খাওয়া ভালো, যত্ন ভালো, থাকার ঘর ভালো, চার্জ কম, এ কি সোজা নাকি? খদ্দের ভাঙে না। সিজনের সময় লোক ধরে না। জায়গা পায় না।
.
সেই কথাই বলে করুণাপদ, এখন এই রকম দেখছেন বাবু, সিজিনের সময় ঠাঁই দেওয়া যায় না। একটা ঘরে দু-তিনটে সিট করতে হয়। এমন একটা চালু ব্যবসা তুলে দেবেন?
সিজনের সময় লোক ধরে না? কমলাক্ষ অবাক হয়ে বলেন, তবে তোমার মার এত অর্থকষ্ট কেন?
করুণাপদ ঘাড় নীচু করে বলে, সে আজ্ঞে বলতে গেলে বাবুর কারণেই।
ওরে করুণা গল্প রাখ। দেখ বাইরে বোধ হয় রিকশা এললীলা এসে ডাক দেয়, ছুটে যা। জানি না কে, যদি খদ্দের হয়, বলবি সিট নেই।
বলব সিট নেই!
বলবি বইকি।
তা হলে তুলেই দিচ্ছেন? তবে যে আমায় বললেন, করুণা তুই—
আরে বাবা সওয়াল সাক্ষী রাখ এখন। ছুটে যা–
কিন্তু যেতে আর হল না করুণাপদকে, ততক্ষণে একটি অষ্টালঙ্কারভূষিতা মহিলা বাড়ির মধ্যে ঢুকে এসেছেন। একেবারে কমলাক্ষর সামনা-সামনিই দাঁড়িয়ে পড়েছেন।
কমলাক্ষ উঠে দাঁড়ান। স্থলিত স্বরে বলেন, এ কী!
মহিলাটি কঠিন মুখে বলেন, আমিও আপনাকে ঠিক সেই প্রশ্ন করছি বাবা!
অন্ধকারের পৃষ্ঠপটে ফুটে উঠেছে আলোকবিন্দু, নিশ্চেতন জড়তার স্তর থেকে উঠে আসছে চেতনার বুদ্বুদ, আতঙ্কের পঙ্ক থেকে জন্ম নিচ্ছে সত্যের শুভ্র কমল।
হঠাৎ বাতাস বন্ধ হয়ে এল বলে দিশেহারা হলে চলবে না, খুলে ধরতে হবে বন্ধ দরজায়। কমলাক্ষ তার সন্তানকে ভয় করবেন না। তার আর নীরজার।
.
ভর রোদ্দুরে এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যে গগনবাবু? কী ব্যাপার?
গগন গাঙুলী সোলার-হ্যাটটা মাথায় চেপে বইয়ে নিয়ে আত্মপ্রসাদের হাসি হাসেন, রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি একটি রগড় দেখার আশায়।
প্রতিবেশী মৃদু হাসেন।এতও রগড় জোটে আপনার!
জুটবে না মানে? ওই তালেই থাকি যে। দুটি বেলা স্টেশন পাহারা দিতে যাই কি আর বেগার খাটতে? এই পলাশপুরে কে মাথাটি ঢোকালো, তার খবরটি নখদর্পণে রাখি। আজ তো জালে একমুনী রুই–
প্রতিবেশীর কাছাকাছি ঘনিষ্ঠ হয়ে আসেন। বলেন, মেয়ে! বুঝলেন? নিজে এসে হাজির হয়েছে। বাপের চুলের মুঠিটি চেপে ধরে নিয়ে যেতে
কে, কার, কি বৃত্তান্ত শ্রোতার অবিদিত। তাই তিনি বোধকরি রহস্য আরও ভেদ হবার আশায় হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন।
গগন গাঙুলী সোলা-হ্যাট সমেত মাথাটা ঝাঁকিয়ে নেন, কী মশাই, হাঁ হয়ে যে? ধরতে পারেননি? নাঃ, রসবোধ বড়ো কম মশাই আপনাদের। প্রফেসরের মেয়ে! এই এগারোটার গাড়িতে এল? গগন গাঙুলী অকারণেই গলাটা নামিয়ে ফিসফিস করে বলেন, বাপের টুটিটি টিপে নিয়ে যেতে এসেছে।
প্রতিবেশী অবাক হন। কি করে জানলেন?
হু হু বাবা! বুঝতে হলে ব্রেন চাই। আর সেই ব্রেনের চাষ করছি কি আজ থেকে? পলাশপুর স্টেশনে পা দিয়েই খোঁজ করেছে ফেরবার গড়ি কখন আছে, টাউনের ভেতর রিকশা-টিকশা পাওয়া যায় কি না। রিকশাওয়ালারা সব রাস্তা চেনে কি না। পারলাম না স্থির থাকতে, এগিয়ে গেলাম। বললাম, কোন্ বাড়িতে যাবে মা লক্ষ্মী! তা মেয়ে তো নয়, যেন আগুনের ডেলা। বলল, জেনে আপনার কী দরকার? শুনুন! ভদ্রলোকের কথা শুনুন! তবু মান খুইয়ে বললাম, আমার আর কিসের দরকার? এই একটু পরোপকার করার ব্যাধি আছে তাই
শুনে একটু নরম হল। বলল, প্রবাস-বোর্ডিং বলে কি হোটেল আছে–
মনকে বলি, ওরে মন, যা ভেবেছিস তাই। আহ্লাদ চেপে বললাম, হা জানি বইকি, ওই দিকেই তো এই অধম ছেলের বাস।…তা বলব কি আপনাকে এমন জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাল, যেন বুকের ভেতর পর্যন্ত সার্চলাইট ফেলল। তারপর কাঠ কাঠ মুখে বলল, ও বুঝেছি। আচ্ছা রিকশাওলাকে জায়গাটা একটু বুঝিয়ে দিতে পারেন তো–
বুঝিয়ে আর কাকে দেব? রিকশাটা তো আমাদের সীতারামের।…তো আমি বলে যাচ্ছি আমিও–
প্রতিবেশী ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকে বলেন, প্রফেসরের মেয়ে, একথা কে বলল? কোনো বোর্ডারও হতে পারে।
বোর্ডার! হাসালেন মশাই। ফিরতি ট্রেনের খোঁজ নিচ্ছিল শুনলেন না? আমি বলছি মেয়ে ছাড়া আর কিছু নয়। মুখের সঙ্গে আদল আছে। বলি আর কে হবে? ওই বয়সের মেয়ে তো আর স্ত্রী নয়?..ওই বাপের অধঃপতনের খবর পেয়ে—মানে কানাঘুসো কিছু শুনে থাকবে এই আর কি। তা বলি এই তো ঘণ্টা দেড় বাদেই ট্রেন, যাবে তো এই পথেই। দেখি একা যায়, না সঙ্গে
নমস্কার মশাই আপনার এনার্জিকে—ভদ্রলোক হেসে উঠে চলে যান, এই ঠায় রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে–
কী করি বলুন। কৌতূহল বড়ো বালাই দাদা!
.
শুধু কৌতূহল কেন, গরজও বড়ো বালাই! সবচেয়ে বড়ো বালাই। নইলে উদ্ধতস্বভাব উন্নাসিক মেয়ে সোমা, ব্ৰজেন ঘোষের হোটেলে এসে হাজির হয়?
আকৃতিতে তরুণী, প্রকৃতিতে মহিলা। পাথর কুঁদে বার করা মুখ দেখলে মনে হয় সে-মুখে যেন বাটালির দাগ রয়ে গেছে, পালিশে মসৃণ হয়ে ওঠেনি।…সেই অমসৃণ মুখের প্রলেপিত ঠোঁট দুটোর কপাট দুটো একটু ফাঁক হয়, যার মধ্যে থেকে কথাটা বেরোয়, অনুগ্রহ করে আপনি একটু বাইরে যাবেন?
অনুরোধ নয়, আদেশ। অনুরোধের ছদ্মবেশেই এল। ভদ্রসমাজের যা দস্তুর।