আবার জ্বরে পড়তে যাব কেন?
যাবে কেন? :। যাবে, নিশ্চয় যাবে। এই এখন থেকে হাটে-ফাটে গেলে পড়তেই হবে। না, তুমি দেশেই চলে যাও।
রাগ করছেন কেন বাবু? রোগের কেঁকে গোঁ ধরেছিলাম বই তো নয়। এখন মায়ের কথাটা তো ভাবতে হবে।
ভাবতে হবে? কমলাক্ষ উত্তেজিতভাবে বললেন, না ভাবতে হবে না। কেন, তুমি ছাড়া তোমার মায়ের জন্যে ভাববার আর লোক নেই?
কমলাক্ষর স্বভাব তো এমন ছিল না। কমলাক্ষ আজকাল বড়ো বেশি উত্তেজিত হচ্ছেন যেন। হঠাৎ স্বভাবটা এমন বদলে গেল কেন কমলাক্ষর?
কী হচ্ছে? লীলার প্রশ্নটা প্রায় একটা ধমকের মতো এসে ধাক্কা দেয়। ও বেচারা রোগা মানুষ, ওকে বকাবকি করছেন কেন? আমিই তো ওকে বলেছি, এখন দেশে গেলে চলবে না বাপু। কে বোর্ডিং-এর দেখাশোনা করবে?
কে দেখাশোনা করবে! কমলাক্ষ ফের চৌকীতে বসে পড়ে বলেন, তা হলে হোটেল চলবে? চালাতে হবে। পেটটা তো চলা চাই?
পেট চালাবার জন্যে ওই করুণাপদকে ভরসা করে এই শত্রুরাজ্যে বসে হোটেল চালিয়েই চলবেন?
তাই তো চালিয়ে এলাম এতদিন। করুণাপদই তো সব দেখেছে। মালিক আর কতই বা দেখেছেন! ইদানীং তো-
তা হোক! কমলাক্ষ ভারী গলায় বলেন, তবু ব্ৰজেনবাবু ছিলেন। সেই থাকাটাই মূল্যবান। এখন এই নিরভিভাবক অবস্থায়—না না, সে তো একেবারেই হতে পারে না।
ভাবছেন কেন? আমি ঠিক চালিয়ে নেব।
চালিয়ে নেবেন! কমলাক্ষ বলে ওঠেন, নেবেন বলেই নিতে দেব? আমি বলছি এ-খেয়াল আপনাকে ছাড়তে হবে।
লীলা একটুক্ষণ থেমে থেমে আস্তে বলে, আপনি বললে, ছাড়তেই হবে। কিন্তু আমার দায়িত্বটা আপনার কর্তব্যের সঙ্গে জড়িয়ে গেলে আপনার জীবনেও তো অনেক জটিলতা এসে দেখা দেবে। কমলাক্ষ গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, জীবন যখন আছে, তখন তার জটিলতাও থাকবে।
৪. গগন গাঙুলী
গগন গাঙুলী পাশের প্রতিবেশীর দাওয়ায় উঠে এসে বলেন, বুঝলেন মশাই, এখন বুঝছি কলকাতার ওই প্রফেসরটি? ওটি হচ্ছে একটি চরিত্রহীন লোক। কে জানে মশাই নাম পরিচয় সত্যি কি। নইলে—মানে বিশ্বাস করবেন, লোক্টা এই মাসাধিককাল ধরে পড়ে আছে আমাদের ব্রজেনবাবুর—না ব্ৰজেনবাবুর আর বলি কি করে—ব্রজেন গিন্নির হোটলে। আমার সন্দেহ হচ্ছে এই ভদ্রলোকের আগমনে, আর ভাবগতিক দেখেই ব্ৰজেন ঘোষটা মনের ঘেন্নায় সুইসাইড করেছে। এদিকে তো আবার লোকটা ইয়ে, খুব সেন্টিমেন্টাল ছিল তো? আপনার কাছে গল্প করেছিলাম মনে আছে বোধ হয়, সেই যেবার আমার বড়ো শালীর মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা সব ওই প্রবাস আবাসে সিট নেওয়ায় ওনাদের স্বরূপ প্রকাশ হয়ে পড়ল?…মনে নেই? বলেন কি? আহা হা—সেই যে, আমার বাড়িতে কুটুমরা এসে পড়েছে, অথচ গিন্নির শরীর খারাপ, ঠেলে তাদের পাঠিয়ে দিলাম এই হোটলে। আর আমার নাতজামাইয়ের দিদি এসে প্রকাশ করে দিল, মাগী বিয়ে করা বর বলে যাকে চালাচ্ছে, সে লোকটা আসলে ওর বাবার চাকর! ওকে নিয়ে ফেরার হয়েছে। সেই সেবার দেখেছি তো।
যখন ডাকিয়ে এনে প্রশ্ন করলাম-খবর সত্যি কি না, তখন ব্রজেনের যা অবস্থা দেখেছিলাম। লজ্জায় বুঝি মারাই যায়। দেখে আশ্চর্যই লাগল যে এই লোক এই কাজ করেছে। এখন বুঝছেন তো কে করেছে? ওই মেয়েমানুষটি। এবার এটি বোধ হয় নতুন প্রেমিক জুটিয়েছেন।
প্রতিবেশী ইতস্তত করে বলেন, কিন্তু ভদ্রমহিলাকে দেখলে তো ঠিক তা মনে হয় না।
শুনুন বিত্তান্ত। দেখলেই যদি চেনা যাবে, তবে আর ছেনাল বলছে কেন? ওই দেখতে যেন কতই আরিস্টোক্র্যাট। আরে মশাই, আমরা মানুষ চিনি। বলে কত অ্যারিস্টোক্রেসি ধুয়ে জল খেলাম। ওই আপনার প্রফেসরটিকেও তো প্রথম দেখে তাই মনে হয়েছিল। এখন দেখছেন তো প্রবিত্তি? দুদিন দেখেই হোটেলওলির সঙ্গে মজে গেলেন।…ওই যখনই দেখেছি এ পথ দিয়ে হাঁটা ছেড়েছে, তখনই বুঝেছি ব্যাপার আছে। আমার তো ধ্রুব বিশ্বাস কোনোরকম বাড়াবাড়ি দেখেই হতভাগা ঘোষটা মরে কেলেঙ্কারি করল। কে জানে চাকর ছোঁড়াটাকেও ভবধাম থেকে সরাবার তোড়জোড় চলছিল কি না।…ডাক্তারবাবুকে ধরে পড়েছিলাম। তা ডাক্তারবাবু বললেন, না, না টাইফয়েড। বিশ্বাস হল না। নির্ঘাৎ টাকা খাইয়েছেন।..যাক, ছোঁড়া নাকি এ-যাত্রা বেঁচে গেছে। তা রাখবে না, দেশে পাঠিয়ে দেবে। তারপর বোধ হয় মাগীকে নিয়ে ভাগবে। বয়সের গাছ পাথর নেই মশাই এদের সব, তবু দেখুন কী প্রবিত্তি!
প্রতিবেশীটি গগন গাঙুলীকে ডরান। তাই প্রতিবাদের সাহস পান না। শুধু বলেন, আপনি এত সব জানলেন কি করে?
আমি? জানলাম কি করে বলছেন? হুঁ! ওইটুকুই সম্বল করেই তো বেঁচে আছি মশাই। নইলে এই পলাশপুরে কি মানুষ টিকতে পারে? যাই দেখি শ্রাদ্ধ আর কতদূর গড়ায়।
ব্ৰজেন ঘোষেদের পরিচয় প্রকাশ হয়ে যাবার পর থেকে প্রবাস আবাসের খদ্দেরের মন ভাঙানোই পেশা হয়েছে গগন গাঙুলীর। ঠিক যেমন তার আগে পেশা ছিল হোটেলের খদ্দের জোগাড় করবার। নিত্য দুবেলা ট্রেনের সময় স্টেশনে হাজির হতেন গগন গাঙুলী, আর যাত্রী দেখলেই বলতেন, উঠবেন কোথায়? বাড়ি ঠিক করে এসেছেন? বিদেশে বেড়াতে এসে মিথ্যে কেন রাঁধাবাড়ার ঝঞ্ঝাটে জড়াবেন মশাই? গেরস্ত পরিচালিত ভালো বের্ডিং রয়েছে। চার্জ কম খাওয়াদাওয়া ভালো, ঘর কমফর্টেবল–।
কিন্তু ওই তাঁর নাতনীর ননদ দ্বারা পরিবেশিত সংবাদের পর থেকেই পেশা বদলে গেল গগন গাঙুলীর। হঠাৎ তার মাথায় ঢুকল ওই শুটকো ব্রজেন ঘোষ আর ওই দেমাকি মেয়েটা তাকে বেদম ঠকিয়েছে।