কমলাক্ষই চমকে গিয়ে চুপ করে থাকেন।
লীলা আবার বলে, এ অভ্যাস ওর নতুন নয়। আমি টাকা বন্ধ করলেই ওই কাণ্ড করত। সেদিন বেশি খেয়ে ফেলেই—দোষ আমারই। দেবতা হবারও যে একটা মাশুল লাগে, সেটা কিছুতেই খেয়ালই করতাম না আমি। পুরোপুরি পাথরের দেবতাই দেখতে চাইতাম। তাছাড়া–হাসল লীলা, টাকাও তো–
কমলাক্ষ ব্রজেন ঘোষকে ভালোবেসেছিল। তাই কমলাক্ষর কণ্ঠে ক্ষুব্ধ স্বর ফোটে, এ তো। একরকম আত্মহত্যাই। এ খবর আপনি জানেন, অথচ একদিনের জন্যে উচ্চারণ করেননি? আশ্চর্য!
আশ্চর্য হচ্ছেন? এটাও আমার পক্ষে আশ্চর্য। আমি যে কত বড়ো নিষ্ঠুর সেটা বুঝি এতদিনও টের পাননি?
না পাইনি। কারণ সত্যি নিষ্ঠুর আপনি নন। করুণাপদর ব্যাপারও তো দেখলাম। শুধু ওই হতভাগা ব্রজেন ঘোষের বেলাতেই—আপনি বলেছিলেন টাকা ছিল না। কিন্তু উনি যখন মারা গেলেন, অনেক টাকা ছিল আপনার কাছে। একগোছা নোট নিয়ে দিতে এসেছিলেন আমাকে–
হঠাৎ হেসে ওঠে লীলা। খুব একটা কৌতুকের হাসি। বলে, এই আপনাদের মতো লোকদের দেখলে আমার বড়ো মায়া হয়। টাকার রহস্যটা বুঝি ফাঁস করিনি এখনও? তাহলে করেই ফেলি, কি বলুন? ঘরে নেই টাকা, অথচ চোখে আছে চক্ষুলজ্জা। দেখুন কী বিপদ? ভেবে দেখলাম এর একমাত্র সমাধান চুরি করা–
চুরি করা। স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকেন কমলাক্ষ।
লীলা তেমনি হাসতে হাসতেই বলে, না তো কি! বিশ্বসুদ্ধ লোকই তো কোনো না কোনো বস্তু চুরি করছে, ওতে আর দোষ কি? আর চক্ষুলজ্জার দায়ে চুরি ডাকাতি তো—যাক ওইসব ভেবে চটপট সমাধানটা করে নিলাম আর সেই চুরির টাকাটা আপনাকে দিতে এলাম।
কক্ষনো না। কমলাক্ষ চটে ওঠেন, যা তা বোঝাতে এসেছেন আমাকে? সেই অবস্থায় আপনি গেলেন চুরি করতে? আর এ আপনার পলাশপুরের লোক এত বেহুঁশ যে দিন দুপুরে বাক্স আলমারি খুলে রেখে ঘুমোচ্ছিল আপনার সুবিধের জন্যে।
লীলার চোখে কৌতুক। লীলার চোখে বিচিত্র এক দৃষ্টি। আর বুঝি বা লীলার চোখে জল।
পলাশপুরের লোক বেহুশ একথা কে বললে আপনাকে? না পলাশপুরের লোক এত বেহুঁশ নয়। বেহুঁশ হচ্ছে কলকাতার লোক, যারা খোলা সুটকেসে, বইয়ের পেজ মার্কে নোটের গোছা রেখে দিয়ে চোরের সুবিধে করে রাখে।
.
বৃষ্টি পড়ছিল।
গ্রীষ্মের আকাশে নতুন মেঘ। কমলাক্ষর জানালা দিয়ে ঝাঁপটা আসছিল, তবু খোলা রেখেছিলেন। আর ভাবছিলেন, এমন আশ্চর্য মেয়ে কি তিনি জীবনে কখনও দেখেছেন? যে-মেয়ে নিজের মুখে স্বীকার করতে পারে, যার সঙ্গে বসবাস করি আমি, সে আমার স্বামী নয়। স্বীকার করতে পারে একটা লুঠেরা তাকে লুটে নিয়ে গিয়ে ধ্বংস করেছে, স্বীকার করতে পারে চক্ষুলজ্জার দায়ে চুরি করতে তার বাধে না। যার ধার ধারে তার বাক্স খুলে চুরি করেই ধার শোধ করতে আসতে পারে সে।
আশ্চর্য! তা সত্যি। তবু মেয়ে। কমলাক্ষ কি করে পারবেন তার দায়িত্ব সম্পর্কে চিন্তা না করতে? অথচ লীলা কিছুতেই এই সহজ কথাটা বুঝতে চাইছে না। বলছে, আমার জন্যে আপনি ভাবতে যাবেন কেন?
কেন কি! মানুষ মানুষের জন্যে ভাববে না?
কমলাক্ষ ঠিক করলেন, লীলাকে কলকাতায় নিয়ে যাবেন, যাতে সেখানেই ওর কোনো একটা কাজকর্ম জোগাড় হয়, তার ব্যবস্থা করে দেবেন। একা থাকবে? তা একা তো ওকে থাকতেই হবে বাকি জীবনটা। তবু কমলাক্ষ তো কাছেই থাকবেন, দেখাশোনা করবেন।
পলাশপুরের এই বাড়িটা! এ-বাড়িটা তো লীলার কাছে মিথ্যা হয়ে গেল। লীলা তো আর প্রবাস বোর্ডিং চালাবে না। বাড়িটা বিক্রি করে বরং লীলার কিছু টাকার সংস্থান করে দিতে পারলে–
মনটা কেমন খচ্ করে উঠল। এই বাড়িটা আর লীলার থাকবে না? কমলাক্ষ জীবনে আর কোনোদিন ওই দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে মাঠের অন্ধকারে চোখ ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পাবেন না?
হঠাৎ মনে হল কমলাক্ষই যদি বাড়িটা কিনে নেন? মানুষ কি এমন মফঃস্বলে বাড়ি-টাড়ি কেনেন? ছুটির সময় মাঝে মাঝে হাঁফ জিরোতে? সেই বেশ। সেই ঠিক। ছুটির সময় লীলারও তো ছুটি-টুটি হবে?
কমলাক্ষ বলবেন, চলুন কটা দিন পলাশপুরে কাটিয়ে আসা যাক।
কল্পনার যৌক্তিক অযৌক্তিকটা মাথায় এল না, একটি জ্যোতির্ময় স্ফটিকের ভেলায় চড়ে সেই কল্পনার সমুদ্রে ভাসতে লাগলেন কমলাক্ষ।
বৃষ্টির শব্দ বহির্জগৎকে আচ্ছন্ন করে দিয়ে বাজতে লাগল ঝিম্ ঝিম্ ঝির ঝির।
মুখুজ্জেবাবু!
একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে দেওয়াল ধরে ধরে এসে দাঁড়িয়েছে লোকটা। ও যে করুণাপদ, তা বুঝতে সময় লাগল কমলাক্ষর। বুঝে চমকে উঠে বললেন, কিরে, তুই আবার এই ঠাণ্ডায় বাইরে এসেছিস কেন?
কম্বল মুড়িয়েছি।
তা বেশ করেছ। কিন্তু কি দরকার? কি বলতে এসেছিস?
আজ্ঞে বলছিলাম কি, আমি আর দেশে যাবার জন্যে বায়না করব না।
স্ফটিকের ভেলাটা একটা ঢেউয়ের ধাক্কায় উল্টে গেল, কমলাক্ষকে আছড়ে ফেলে দিল বালির চড়ায়। কমলাক্ষ সেই আছাড়ের ধাক্কায় ছিটকে উঠলেন।
বায়না করবে না! চমৎকার! তা কেন করবে না সেটি শুনতে পাই না?
আজ্ঞে তখন অসুখের ঘোরে বাড়ি বাড়ি মন করেছিল। এখন চিন্তা করে দেখছি চলে গেলে মায়ের অসুবিধে।
মায়ের অসুবিধে! চিন্তা করে দেখছ! কমলাক্ষ চৌকী ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ওর কাছে সরে এলেন, ব্যঙ্গ আর বিদ্রূপ মিশ্রিত চড়া গলায় বলে উঠলেন, খুব যে চিন্তাশীল হয়ে উঠেছ দেখছি। বলি, আবার যদি তুমি জ্বরে পড়, মায়ের সুবিধেটা কোথায় থাকবে, সেটা চিন্তা করে দেখেছ?