ক্যালেন্ডারের পাতার দিকে তাকিয়ে সেই কথাই ভাবছিলেন কমলাক্ষ। আজ ফিরবার কথা ছিল। কলকাতা বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে তার একটা কর্মর্জগৎ আছে, এসব যেন ঝাঁপসা হয়ে গেছে। আর প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের সেই ছোটো দোতলা বাড়িখানা? সেটাই কি স্পষ্ট আছে?
সে-বাড়িতে কি কখনও কারও অসুখ করেনি? কই কমলাক্ষর তো মনে পড়ছে না, তিনি কোনোদিন নিজের হাতে বরফ ভেঙেছেন, ফলের রস করেছেন, পাখা হাতে রাত জেগেছেন। ব্রজেন ঘোষের চাকর করুণাপদর জন্যে এসব করেছেন কমলাক্ষ। ব্রজেন ঘোষের কাছে কত ধার ছিল কমলাক্ষর?
তবে আশ্চর্য, খুব খারাপও কিছু লাগেনি। বরং কেমন একটা দৃঢ়তা আর উৎসাহের ভাবই মনে এসেছে। যে-রাত্রে তাঁর জাগার জন্যে লীলার একটু ঘুমোতে পেয়েছে, সে রাত্রিটা তো মধুর একটা গানের মতো লেগেছে।
আর যে-রাত্রে রুগী বিকারের ঝেকে তেড়ে তেড়ে ওঠার জন্যে দুজনকেই জেগে বসে থাকতে হয়েছে?
ও রকম ভীতিকর পরিস্থিতিটাও অমন ভালো লাগত কি করে ভেবে পাচ্ছেন না কমলাক্ষ। প্রবাস আবাসের এই বাড়িটার মোহময় জাদু? যে-জাদুর ছোঁয়ায় প্রথম দিনই কমলাক্ষ যেন আর এক জগতের খোলা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন?
.
কিন্তু বড়ো বেশি ভালোলাগা সেই দক্ষিণের জানলাগুলো তো কতদিনই খোলা হয়নি। সে-ঘরে থাকাই হয়নি কতদিন।
করুণাপদর জ্বরটা যেদিন চড়ে উঠে বিকারে দাঁড়াল, সেদিন কমলাক্ষ হাসপাতালের কথা তুলেছিলেন। লীলা বলেছিল, হাসপাতালে দেওয়া যাবে না। হাসপাতালে ওর বড়ো ভয়। একবার পক্স হয়েছিল, হাসপাতালের নাম শুনে হাউ হাউ করে কেঁদেছিল। ওর ধারণা যে ওখানে গেলেই মরে যাবে।
কমলাক্ষ বলেছিলেন, ওদের ক্লাসের সকলেরই প্রায় ওই ধারণা। কিন্তু এখন তো ও টেরও পাবে না কোথায় আছি। দিলে ফল ভালো হত।
লীলা হেসেছিল, ফল ভালো হবেই এমন গ্যারান্টি কে দিচ্ছে? খারাপও হতে পারে। তেমন হলে নিজেকে আমি কি জবাব দেব বলুন? মা বাপ ছেড়ে এসেছে, আমায় মা বলে ডাকে–
কি একটা কাজের ছুতোয় তাড়াতাড়ি উঠে গিয়েছিল লীলা। আর কমলাক্ষ স্টেশনে ছুটেছিলেন বরফ আনতে। তারপর কে জানে কোথা দিয়ে কেটে গেছে এতগুলো দিনের দিনরাত। দিনগুলি যে এতগুলো, আজ ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে অনুভব হচ্ছে।
পুণ্ডরীকের চিঠিখানা খুললেন কমলাক্ষ। সকালের ডাকে যেটা এসেছে ও জানিয়েছে, আজই যখন কমলাক্ষর ফেরার দিন, তখন আর বাড়তি ব্যস্ত করবার দরকার বিবেচনা করেনি সে, তবে জানিয়ে যাবার জন্যে জানাচ্ছে, কয়েকদিনের জন্যে দার্জিলিং যাচ্ছে সে আজ। আর যাবার আগে তার দিদিকে শ্বশুরবাড়ি থেকে আনিয়ে বাড়িতে রেখে যাচ্ছে। খুব স্বাভাবিক আর সাধারণ চিঠি। শুধু শেষের একটা লাইন ঘুরে ফিরে চোখের সামনে এসে যেন তর্জনি তুলে দাঁড়াচ্ছে–
লাইনটা পুনশ্চর–
হ্যাঁ ভালো কথা—আপনার পলাশপুর থেকে একটা অদ্ভুত চিঠি এসেছে, অর্থ হৃদয়ঙ্গম হল না। লেখকের নামও নেই।
কী সেই অদ্ভুত চিঠি? যার অর্থ হৃদয়ঙ্গম হয় না?
কমলাক্ষ কি ছেলের এই চিঠির কথা লীলাকে বলবেন? বলবেন, দেখুন তো আপনাদের এখান থেকে আমরা ছেলের কাছে বেনামী চিঠি লেখবার দরকার কার পড়ল? কে আছে তেমন লোক?
অবশ্য কে আছে সেটা বোঝা শক্ত নয়। কমলাক্ষ সনাক্ত করেছেন তাকে। গগন গাঙুলী ছাড়া আর কে?
অপরের কথা ভিন্ন যারা থাকতে পারে না, অপরের একটু অনিষ্ট করতে পেলে যারা মনে করে জগতে এসে তবু একটা পরম কিছু করা হল—গগন গাঙুলী সেই জাতের লোক।
কিন্তু কী লিখেছে সে? যার অর্থ হৃদয়ঙ্গম হয় না?
পুণ্ডরীক লিখেছে, দিদিকে এনে রেখে যাচ্ছি। আর আপনি তো কালই এসে পড়ছেন। কমলাক্ষর খেয়াল হল পলাশপুরে এসে পর্যন্ত মেয়েকে তিনি একটাও চিটি দেননি। খুব বেশি চিঠি দেওয়ার অভ্যাস তাঁর না থাকলেও, এক আধটা দেওয়া উচিত ছিল। দেননি। দেবার কথা মনেও পড়েনি। কমলাক্ষ ভাবলেন, আজ আমার যাবার কথা ছিল।
ভাবলেন, আজ আমি যাব কি করে?
.
আমার কথা ভাবছেন আপনি? লীলা সত্যি অবাক হয়ে গেছে। আমার কি হবে, সে-কথা আপনি ভাবতে বসবেন।
কমলাক্ষ ইচ্ছে হল খুব ভালো একটা উত্তর দেন, কিন্তু মুখে জোগাল না কিছু। তাই বললেন, তা একজন কাউকে তো ভাবতে হবে?
কেন? হবে কেন? ভগবানও যার জন্যে ভাবছেন না, এমন লোকেরই কি অভাব আছে সংসারে?
বিশ্ব সংসারে সবাইয়ের ভাবনা ভাববার গরজ আমার সেই।
কিন্তু আমার ভাবনা ভাববার গরজই বা কেন হচ্ছে আপনার, সেও তো এক রহস্য।
কমলাক্ষ উত্তেজিত হলেন। বললেন, সেটা একটা রহস্য হল আপনার কাছে? ব্রজেনবাবু মদের বদলে স্পিরিট খেয়ে মরবেন, করুণাপদ দেশে যাবে বলে গোঁ ধরবে, আর
হঠাৎ থেমে গেলেন। রাগের মাথায় ব্ৰজেনবাবুর মৃত্যু রহস্যটা এইভাবে উদঘাটিত করে ফেলে মরমে মরে গেলেন। চাবুক মারতে ইচ্ছে হল নিজেকে। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা দিলে তিনি!
গণ্ডমুখ্যু ব্রজেন ঘোষ যে লীলার কাছে কি, তা তো তার অবিদিত নেই। তার মৃত্যুর এই শোচনীয় কারণটা জানিয়ে লীলাকে নতুন করে আবার শোকের মধ্যে ফেললেন তিনি। রাগলে এত গোঁয়ার হয়ে ওঠেন তিনি, তা তো জানা ছিল না!
কিন্তু কই, চমকে উঠল না তো লীলা! শুনে কাঠ হয়ে গেল না তো? সেই ওর নিজস্ব ভঙ্গিতে একটু ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলল, স্পিরিট খাওয়ার কথাটা জানা হয়ে গেছে আপনার?