লজ্জায় মাথাকাটা গেল। তবু লীলার ওই একঝাঁক কথার একটা উত্তর না দিয়ে পারলেন না। বললেন, এতগুলো কথা ভাবতে পারলেন, আর চলে যাওয়াটা সম্ভব কি না সেটা ভাবতে মনে পড়ল না?
লীলার মুখটা কী ক্লান্ত বিবর্ণ শুকনো দেখাচ্ছে। প্রথম যেদিন এসে দেখেছিলেন, তার থেকে কত বদলে গেল। সাজ বদল করেনি, তবুও কী বদলানোই বদলেছে!
তা হোক, শুকনো বিবর্ণ ক্লান্ত যাই হোক, হাসিটা ঠিক আছে। আর বোধ করি হেসে ভিন্ন কথা কইতেই পারে না লীলা। কে জানে, গগন গাঙুলীদের সাথে কথা বলতে হলেও লীলা এমনি হাসি মিশিয়ে কথা কয় কি না।
লীলা হাসল। সেটা মনে পড়ানো উচিত ছিল বুঝি?
ছিল।
তবে আমারই অন্যায়। কিন্তু মানুষের হিসেব মতো আপনার তো চলে যাবারই কথা।
কমলাক্ষ বললেন, মানুষের হিসেবে যখন মিলছে না, তখন বোধ করি অমানুষ। নইলে আর হাটে যাব বলে বেড়িয়ে এসে শুধু হতে বাড়ি ফিরি?
হাটে যাবেন বলেই বেরিয়েছিলেন বুঝি?
এখন তো তাই মনে হচ্ছে।
তখন হচ্ছিল না?
কি জানি।
সহসা একটু গম্ভীর হয়ে যায় লীলা। গম্ভীর হয়ে বলে, কিন্তু কেনই বা আমাকে ঘেন্না করবেন না আপনি?
তাই তো আমিও ভাবছি সেই থেকে।
কমলাক্ষ তাকালেন বিচিত্র একটা দৃষ্টিতে। যে-দৃষ্টির খবর তিনি নিজেও জানেন না।
আমার সব কথা শুনলে, এ-ভাবনা বজায় রাখা শক্ত হবে। ঘেন্না না করে পারবেন না।
কমলাক্ষ মৃদু হাসলেন। সবই শুনেছি।
সব? বলুন তো শুনি কতটা কি শুনেছেন।
কমলাক্ষ আর একটু হাসলেন। বললেন, বেশি বলার দরকার কি? গগন গাঙুলীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, এইটুকু বললেই বুঝে নিতে পারবেন না?
লীলা কিন্তু আর হাসে না। লীলা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায়। আর সেই গম্ভীর হয়ে যাওয়া লীলাকে দেখে মনে হয় এই বুঝি আসল লীলা। ওই হাসি মেশানে কথা কওয়া লীলা, সাজানো লীলা। ওটা লীলার ছদ্মবেশ। অত গভীরতায় তলিয়ে থাকলে, কেউ ওর নাগাল পাবে না বলে দয়া করে ওই হালকা হাওয়ার চাদরটা জড়িয়ে বসে আছে।
এখন লীলা সেই ছদ্মবেশ ত্যাগ করেছে। নিজের আসল সুর আর স্বর নিয়ে বলছে, গগন গাঙ্গুলীই কি সব জানে?
কমলাক্ষ উত্তর দিলেন না। এই গভীরতাকে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখবার ইচ্ছে হল না তার। চুপ করে থাকলেন।
লীলাই ফের কথা বলল। জানে না। জানে কি, বামুনের মেয়ে হয়ে শূদ্রের ছেলের সঙ্গে, মনিবের মেয়ে হয়ে চাকরের সঙ্গে, পালিয়ে আসা ছাড়াও, আরও ভয়ঙ্কর অপবিত্রতা আছে আমার মধ্যে? জানে কি, বিখ্যাত সেই আপনাদের দাঙ্গার হাজার বলির মধ্যে আমিও একটা বলির পশু?
কমলাক্ষ বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। অস্ফুটে একবার যে উচ্চারণ করেছিলেন চাকর? আর তার উত্তর পাননি, সে-কথা ভুলেই গেলেন।
কিন্তু লীলা বুঝি ভোলেনি। তাই লীলা বলে ওঠে, লোকে বলে চাকর। পরিচয়টা তাই ছিল। বাবার প্রেস ছিল, আর ও ছিল সামান্য কম্পোজিটার। প্রুফ কারেক্টার নিমাইবাবু নাকি বলতেন, ছাপাখানার সব ভূত কি তোর মাথাতেই এসে অধিষ্ঠান করে ব্রজেন?…তা হয়তো তাই। খুব আস্তে আস্তে ফেলা একটা নিশ্বাস যেন চুপি চুপি বাতাসের সঙ্গে মিশে যেতে চাইল। যেন ওকে দেখতে পাওয়া গেলে লজ্জায় নীল হয়ে যাবে ও।
ভূতই অধিষ্ঠান করেছিল ওর মাথায়। নইলে মেয়ে লুঠ হয়ে যাবার পর মা-বাপ পর্যন্ত যখন মনে করব মরে গেছে বলে নিশ্চিন্ত হয়েছিল, মাইনে করা চাকর ব্রজেন ঘোষের কি দরকার পড়েছিল জীবন মরণ তুচ্ছ করে তাকে খুঁজে বেড়ানোর? কী দরকার পড়েছিল বাঘের গুহা থেকে উদ্ধার করে এনে আজীবন তাকে মাথায় বয়ে বেড়ানোর?
কমলাক্ষ এবার কথা বললেন বাড়িতে বুঝি আর গ্রহণ করলেন না?
পাগল হয়েছেন? তাই কখনও করে? তাদের আরও সব রয়েছে না? একটা মেয়ের জন্যে সব খোয়াবে নাকি? থাক, ও তো একেবারে পচা গলা কথা। হাজার হাজার জনের একজন আবার নতুন কথা কি শোনাবে? নতুন শুধু ওই রোগা হ্যাংলা মুখচোরা কম্পোজিটারটার পাগলামীর গল্প। তার আগে লোকটা মনিবের মেয়ের সঙ্গে গুনে দশটা কথাও বলেছে কি না সন্দেহ! অথচ—সাধে কি আর বলছি ভূতাতি! নইলে ওইটুকুকে সম্বল করে দুর্জয় সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে? আর সারাজীবন একটা অশুচি অপবিত্র বোঝা মাথায় নিয়ে–
কমলাক্ষ স্থির স্বরে বললেন, এ পর্যন্ত সবই বুঝতে পারলাম। বুঝতে অসুবিধে হল না। শুধু একটা কথা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে—সংসার যখন আপনাকে ত্যাগ করেছিল, বিয়েটার বাধা ছিল কোথায়?
লীলা মিনিট খানেক চুপ করে থেকে বলে, সে কথা এই খানিক আগেই ভাবছিলাম। বাধা ছিল হয়তো ওর নিজের মধ্যেই। নিজেকে বোধ করি মনে মনে কিছুতেই আর মনিবের মেয়ের পর্যায়ে তুলতে পারল না। তাই সমস্ত সাজানো পরিচয়, ড্রইং রুমের সাজের মতো বাইরেই পড়ে থাকল। ও শুধু সৃষ্টিছাড়া এক অস্বস্তি নিয়ে সারা জীবন পালিয়ে বেড়াল।
কেন কে জনে কমলাক্ষ সহসা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। আরক্ত মুখে বলেন, বাধা শুধু তাঁর মধ্যেই ছিল না, ছিল আপনার মধ্যেও। নইলে সেই, সৃষ্টিছাড়া অস্বস্তির বাধা ধূলিসাৎ হতে দেরি হত না। আপনিও কোনোদিন তাকে মানুষ ভাবেননি। তাই–
তা সত্যি–কথার মাঝখানেই উত্তর দেয় লীলা। আস্তে শান্ত গলায় বলে, সত্যিই মানুষ ভাবিনি! রক্তমাংসের মানুষ! পাথরের দেবতাই ভেবে এসেছি বরাবর।
.
জরাজীর্ণ দেহটা নিয়ে করুণাপদ যেদিন পোরের ভাত দিয়ে পথ্যি করতে বসল, সেদিন কমলাক্ষর ছুটির শেষ দিন।