মিসির আলি জানেন এই সবই হচ্ছে বয়সের লক্ষণ। বয়স মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষতি যা করে-তা হল আস্থা কমিয়ে দেয়। যা-ই করা হয় মনে হয় ঠিকমতো বুঝি করা হল না। ভুল থেকে গেল।
স্যার গরম জল।
বুঝতে পারছি।
সিনান করলে করেন।
গোসল করব না।
বড় সাব সিনান করতে বলেছেন।
তোমার বড় সাহেব বললে তো হবে না। আমার গোসল করতে ইচ্ছে করছে না।
আর কিছু লাগবে?
না আর কিছু লাগবে না। ভালো কথা-তুমি গরম পানি না বলে গরম জল বলছ কেন? তোমাদের এদিকে কি পানিকে জল বলা হয়? এটা কি হিন্দুপ্রধান অঞ্চল?
বরকত জবাব দিল না। সরু চোখে তাকিয়ে রইল। মিসির আলি বললেন, আচ্ছা! ঠিক আছে তুমি যাও।
যাও বলার পরেও সে যাচ্ছে না। আগের মতোই সরু চোখে তাকিয়ে আছে। বলশালী একজন মানুষ। বয়স কত হবে ত্রিশ কিংবা পঁয়ত্রিশ। বেশিও হতে পারে। চুলে পাক ধরেছে। মানুষটার বুদ্ধি কেমন? চট করে মানুষের বুদ্ধি বের করার কোনো উপায় এখনো বের করা যায় নি। সাইকোলজিস্ট্ররা নানান ধরনের পরীক্ষা অবিশ্যি বের করেছেন। কোনো পরীক্ষাই মিসির আলির কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। আসলে বুদ্ধি পরীক্ষার ব্যবস্থা না থেকে থাকা উচিত ছিল বোকামি পরীক্ষার ব্যবস্থা। প্রথম শ্রেণীর বোকাদের জন্যে এক রকম পরীক্ষা। দ্বিতীয় শ্রেণীর বোকাদের জন্যে আরেক রকম পরীক্ষা।
বরকত চলে যাচ্ছে। যেতে যেতেও দুবার ফিরে তাকাল। সিঁড়ির কাছে অন্ধকার। কাজেই তার চোখের দৃষ্টিতে কী আছে বোঝা যাচ্ছে না। কিছু একটা নিশ্চয়ই আছে। নয়তো এতিবার করে তাকাত না।
মিসির আলি নিজের ঘরে ঢুকলেন। ঘরটা নিজের মতো করে সাজিয়ে নেওয়া দরকার। নিজের গায়ের গন্ধ ঘরময় ছড়িয়ে দিতে হবে। গন্ধ যত ছড়াবে ঘর হবে তত আপন। নিম্নশ্রেণীর পশুরা তাই করে। নিজের গায়ের গন্ধ দিয়ে সীমানা ঠিক করে দেয়। অদৃশ্য সাইনবোর্ড গন্ধ দিয়ে বলে-এই আমার সীমানা। এর ভেতর আর কেউ আসবে না। যদি তুলে চলেও আস, বেশিক্ষণ থাকবে না। থাকলে সমূহ বিপদ।
মিসির আলি সুটকেস খুলে বই বের করলেন। চারটা বইয়ের মধ্যে একটা হল ক্লোজ-আপ ম্যাজিকের বই। দড়িকাটার খেলা, পিংপং বল অদৃশ্য করে দেবার খেলার মতো ছোট ছোট ম্যাজিকের কৌশল দেওয়া আছে। পড়তে ভালো লাগে। তিনি বইগুলি টেবিলে সাজিয়ে রাখলেন। এত বড় টেবিলে চারটা মাত্র বই দেখতে হাস্যকর লাগছে। মিসির আলি ঠিক করে রাখলেন-এ বাড়ির লাইব্রেরি থেকে বেশ কিছু বই এনে টেবিল ভর্তি করে রাখবেন। চোখের সামনে প্রচুর বই থাকলে ভালো লাগে।
আবারো সিঁড়িতে থপথপ শব্দ হচ্ছে। বরকত কি আবারো ভারী কিছু নিয়ে উঠছে? ব্যাপারটা কী? এবার সে কী আনিছে? মিসির আলি দ্রুত বারান্দায় চলে এলেন। বরকত ভারী কিছু তুলছে না। তার হাতে ছোট্ট তেলের শিশির মতো শিশি। অথচ এমনভাবে সে উঠছে যেন তার উঠতে কষ্ট হচ্ছে। মাঝে মাঝে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সে বিশ্রামও করে নিচ্ছে বলে মনে হয়। এমন স্বাস্থ্যবান একজন মানুষের সিঁড়ি ভাঙতে কোনো কষ্ট হবার কথা না। অথচ তার যে কষ্ট হচ্ছে এটা পরিষ্কার। হার্টের কোনো অসুখ কি আছে? কিংবা আর্থরাইটিস? ওঠার সময় হাঁটুতে ব্যথা করে?
বরকত মিসির আলির সামনে এসে বলল, ওষুধ নিয়া আসছি।
মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, কীসের অষুধ?
সাপের অষুধ। আপনের ঘরের চারদিকে দিয়া দিব।
ঘরের চারদিকে সাপের অষুধ দেবে মানে কী? দোতলায় সাপ আসবে কীভাবে?
বরকত প্রশ্নের জবাব দিল না। ঘরে ঢুকে গেল। মিসির আলি বারান্দায় দাঁড়িয়েই তীব্ৰ কাৰ্বালক এসিডের গন্ধ পেলেন। তাঁর গন্ধ বিষয়ক সমস্যা আছে। কিছু কিছু গন্ধ মনে হয় তাঁর স্নায়ুতে সরাসরি আক্রমণ করে। চট করে মাথা ধরে যায়। কার্বলিক এসিডেও তাই হয়েছে। মিসির আলি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে ভাবলেন, শুধু সাপ না, আমি নিজেও আর এই ঘরে ঢুকতে পারব না। এই গন্ধ নিয়ে বাস করার চাইতে ঘরে দুতিনটা সাপ নিয়ে বাস করা অনেক সহজ। মশারি ভালোমতো খুঁজে দিয়ে রাখলে সাপ ঢুকতে পারবে না। সাপকে খাটে উঠতে হলে খাটের পা বেয়ে উঠতে হবে। সাপের জন্যে এই প্রক্রিয়া খুবই কষ্টকর হবার কথা। সাপ শুধু শুধু এত কষ্ট করবে না।
বরকত নেমে যাচ্ছে। শিশিটা নিশ্চয়ই ঘরে কোথাও রেখে এসেছে। বোতল থেকে গন্ধ বের হচ্ছে! আচ্ছা বোতলাটা সে কোথায় রেখেছে? খাটের নিচে রেখেছে নিশ্চয়ই। মশার কয়েল জ্বালিয়ে আমরা বেশির ভাগ সময় জ্বলন্ত কয়েলটা খাটের নিচে রেখে দেই।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে বরকতের তেমন কষ্ট হচ্ছে বলে মনে হলো না। বেশ দ্রুতই নামছে। বরকতের আর্থরাইটিস নেই, এটা নিশ্চিত।
সিঁড়ির শেষ মাথায় ছোট একটা শব্দ হল। জায়গাটা গাঢ় অন্ধকার। তারপরেও মিসির আলির মনে হল কে যেন সেখানে বসে আছে। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকে দেখছে। মিসির আলির মনে হল তার হাতে একটা টর্চ থাকলে ভালো হত। টর্চের আলো ফেলে। দেখা যেত কে ঘাপটি মেরে বসে আছে। তিনি সিঁড়ি বেয়ে দুধাপ নামলেন। উঁচু গলায় বললেন, কে? কে ওখানে?
কেউ জবাব দিল না। মিসির আলি আরো কয়েকটা সিঁড়ি টপকালেন। আর তখনি শান্ত গভীর পুরুষ গলায় কেউ একজন বলল, স্যার রেলিং ধরে ধরে নামুন। খুব খেয়াল রাখবেন যতবার ওঠানামা করবেন। রেলিং ধরে ধরে করবেন। আমার নাম সুলতান। ওয়েলকাম টু মাই ধ্বংসস্তুপ। ধ্বংসস্তুপের ইংরেজিটা মনে পড়ছে না বলে বাংলা বললাম। স্যার কেমন আছেন?