ঘড়ঘড় শব্দ হল। মিসির আলির চোখ হঠাৎ ধাঁধিয়ে গেল। গেট খুলেছে। গেটের ওপাশে জাহাজি লণ্ঠন হাতে লিলি দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে দারোয়ান। দারোয়ানের হাতে লম্বা টর্চ। পাঁচ ব্যাটারির টর্চ নিশ্চয়ই। এই টর্চে আলো ফেলে দেখতে ইচ্ছা করছে—আলো কেমন হয়।
লিলি বলল, স্যার আসুন। ওর শরীরটা খারাপ বলে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে। আর আমি খুঁজে পাচ্ছি না হারিকেন। বরকতকে দেখুন এত লম্বা টর্চ নিয়ে ঘুরছে। টর্চে নেই ব্যাটারি। ব্যাটারি ছাড়া টর্চ হাতে নিয়ে ঘোরার দরকারটা কী স্যার আপনিই বলুন। আপনাকে ব্যাগ হাতে নিতে হবে না। বরকত নেবে।
মিসির আলি বললেন, তোমার কুকুর কি বাধা হয়েছে?
হ্যাঁ বাধা হয়েছে। সকালে কুকুরগুলির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব তখন আর আপনাকে কিছু বলবে না। আপনার থাকার ব্যবস্থা করেছি। দোতলার সবচেয়ে দক্ষিণের ঘরে। ঘরটা তেমন ভালো না, তবে খুব বড় ঘর। এই ঘরের খাটটা সুন্দর। অন্য ঘরগুলিতে এত সুন্দর রেলিং দেওয়া খাট নেই।
লণ্ঠনের আলোয় বাড়িঘর কিছু দেখা যাচ্ছে না। লণ্ঠন তার চারপাশ আলো করছে। দূরে আলো ফেলতে পারছে না। লণ্ঠন এবং টর্চের এই হল তফাত-লণ্ঠন নিজেকে আলোকিত করে। নিজেকে দেখায়। টর্চ অন্যকে আলোকিত করে।
সিঁড়িটা সাবধানে উঠবেন স্যার। শ্যাওলা জমে কেমন পিছলা হয়ে গেছে। রেলিং ধরে উঠুন। আপনার নিশ্চয়ই খুব ক্ষিধে লেগেছে। ক্ষিধে লেগেছে না স্যার?
হুঁ লেগেছে।
আপনি হাত-মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম করুন। আমি খাবার রেডি করে ফেলব। এর মধ্যে কোনো কিছুর দরকার হলে দোতলার বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়াবেন। মাথা নিচু করে বরকত বরকত করে ডাক দেবেন। আমাদের একটাই কাজের লোক বরকত। একের ভেতর চার। সে-ই দারোয়ান, সে-ই কেয়ারটেকার, সে-ই মালি, সে-ই কুকুর-পালক। ভাত খাবার আগে চা-কফি কিছু খাবেন?
খেতে পারি।
আমি এক্ষুনি বরকতকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
তোমার হাজবেণ্ডের সঙ্গে কি রাতে দেখা হবে?
অবশ্যই হবে।
অসুস্থ বলছিলে।
অসুস্থ হোক যাই হোক গেস্টের সঙ্গে দেখা করবে না?
মিসির আলির ঘর পছন্দ হল। পুরোনো বাড়ির একটা সুন্দর ব্যাপার হল–ঘরগুলি প্রকাণ্ড। ছোটখাটো ফুটবল খেলার মাঠ। কড়ি বর্গার ছাদ অনেক উঁচুতে। ছাদ থেকে লম্বা লম্বা লোহার রড নেমে এসেছে। রড়ের মাথায় ফ্যান। এক শোবার ঘরেই চারটা ফ্যান। ইলেক্ট্রিসিটি ছাড়া এই ফ্যান চলার কথা না। কাজেই ধরে নেওয়া যেতে পারে এদের জেনারেটর আছে। ফ্যানগুলি পুরোনো আমলের ডিসি ফ্যান না। আধুনিক কালের ফ্যান। ফ্যানের পাখায় জমে থাকা ময়লা থেকে বোঝা যায় যে ফ্যানগুলি ব্যবহার করা হয়।
ঘরে শোবার খাট দুটা। চারপাশে রেলিং দেওয়া প্ৰকাণ্ড খাটটা ঘরের মাঝামাঝি রাখা। এই খাটে ওঠার জন্যে দুই ধাপ সিঁড়ি আছে। জানালার পাশে খাটের সাইজেরই একটা টেবিল। বিশাল টেবিলের সঙ্গে বেমানান ছোট একটা চেয়ার চেয়ার টেবিলের উলটোদিকে দুটা আলমিরা। কাঠের আলমিরা তালাবন্ধ। চারটা সোফার চেয়ার। চেয়ারে সবুজ মখমলের গদি। চেয়ারের পাশে পুরোনো ডিজাইনের দুটা আলনা। তারপরেও মনে হচ্ছে ঘরটা ফাঁকা। দুটা খাটেই বিছানা করা হয়েছে। কিছুক্ষণ আগেই করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। একটায় বিছানো হয়েছে। ধবধবে সাদা চাঁদ র। সাদা বালিশের ওয়ার। রেলিং দেওয়া খাটে সবকিছুই রঙিন। তবে দুটো খাটেই কোলবালিশ আছে। মিসির আলি বাথরুমে উঁকি দিলেন। বাথরুমও প্রায় শোবার ঘরের মতোই বড়। খুবই আধুনিক বাথরুম। এই বাথরুম অবশ্যই পরে বানানো হয়েছে। যে সময়ের বাড়ি সে সময়ে টাইলস নামক বস্তু বাজারে আসে নি।
বাথরুমটা শুধু যে ঝকঝকি করছে তা না, বড় বড় হোটেলের মতো করে গোছানো। বেসিনের উপর সাবান, টুথপেষ্ট এবং একটা মোড়ক-না-খোলা টুথব্রাশ। তোয়ালে রাখার জায়গায় তোয়ালে ঝুলছে। ময়লা নয়-মনে হচ্ছে এইমাত্র ধোপাখানা থেকে নিয়ে আসা।
মিসির আলি বেসিনের কালে পানি আশা করেন নি। দোতলায় পানি আসতে হলে ছাদে পানির ট্যাংক থাকতে হবে। সেই ট্যাংকে পানি তোলার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ট্যাপ খুলতেই পানি পাওয়া গেল। অনেকদিন অব্যবহারের পর হঠাৎ কল খুললে লাল পানি বের হয়–সে রকম পানি না। পরিষ্কার পানি। মিসির আলি মুখে পানি ছিটালেন।
সিঁড়িতে থপথপ শব্দ করতে করতে কেউ-একজন আসছে। বাড়ির মালিক নিশ্চয় নিন। তিনি হুইল চেয়ারে থাকেন। তাহলে কে আসছে–দারোয়ান? একেকটা সিঁড়ি ভাঙতে এত সময় নিচ্ছে কেন? নিশ্চয়ই ভারী কিছু নিয়ে আসছে। সেই ভারী বস্তুটা কী হতে পারে? চেয়ার-টেবিল কাঁধে করে আনবে না। তাঁর ঘরে চেয়ার-টেবিল আছে। বালতিতে করে গরম পানি কি আনিছে? রাতের বেলার অতিথিদের গরম পানি দেওয়ার রেওয়াজ আছে। অতিথি গরম পানিতে গোসল করবেন, কিংবা হাত-মুখ ধোবেন। তাঁর প্রতি যে বিশেষ যত্ন নেওয়া হচ্ছে তাতে সেটা প্ৰকাশ পাবে।
না বালতি নিয়ে কেউ আসছে না। বালতি হলে মাঝে মাঝে সিঁড়িতে নামিয়ে রাখত। তার শব্দ পাওয়া যেত। সেই শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। মিসির আলি ঘর থেকে বের হয়ে বারাণদায় চলে এলেন।
দারোয়ান বরকত আসছে। তার কোমরে মাটির কলসি। কলসির মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে, তার মানে কলসিতে করে গরম পানিই আনা হচ্ছে। মিসির আলি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। যাক লজিক শেষ পর্যন্ত কাজ করেছে। সিদ্ধান্তে আসার পরই টেনশন বোধ করা শুরু করছেন। লজিকের যে সিঁড়িগুলি গাথা হয়েছে সেই সিড়িগুলি কি ঠিক আছে? সিঁড়ি বেয়ে ওঠা যাবে তো?