জি না সমস্যা নেই।
তাহলে চল কফি শেষ করে রওনা দিয়ে দেই।
কফি খেতে কেমন হয়েছে আপনি কিন্তু এখনো বলেন নি।
মিসির আলি নিচু গলায় বললেন, এত ভালো কফি আমি আমার জীবনে খেয়েছি বলে মনে পড়ে না।
লিলি ক্লান্ত গলায় বলল, থ্যাংক য়্যু।
সে তার মাথার নীল স্কার্ফ খুলে বিশেষ কায়দায় মাথা ঝাকি দিয়েছে। তার চুল ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। চেহারা আবার প্যান্টে গেছে।
মিসির আলির মনে হল মেয়েটা কখন কী করবে। সব আগে থেকে ঠিক করা। সে যে একটানে মাথা থেকে স্কার্ফ খুলে মাথা ঝাকাবে এটাও সে আগে থেকেই ঠিক করে এসেছে।
গা ছমছম করছে
মিসির আলি হঠাৎ লক্ষ্য করলেন তার গা ছমছম করছে। যেন অশুভ কিছু তার জন্যে অপেক্ষা করছে। ভয়ঙ্কর কিছু। লৌকিক কিছু না, অলৌকিক কিছু। অনেককাল আগে তার একবার এ রকম অনুভূতি হয়েছিল। শ্যামগঞ্জ রেলস্টেশনে অপেক্ষা করছেন। গভীর রাত। তিনি এগারো সিন্ধুর এক্সপ্রেসে ভৈরব যাবেন। ট্রেন আসবে ভোররাতে। পৌষ মাসের মাঝামাঝি। প্রচণ্ড শীত। ওয়েটিং রুমে বসে সময় কাটানোর জন্যে ঢুকতে যাবেন হঠাৎ তার পা জমে গেল। বুক ধকধক করতে লাগল। মনে হল ওয়েটিং রুমে অশুভ কিছু আছে। ভয়ঙ্কর কিছু। যে ভয়ঙ্করের কোনো ব্যাখ্যা নেই। তার উচিত কিছুতেই ওয়েটিং রুমে না ঢোকা। একবার ঢুকলে আর বের হতে পারবেন না।
কৌতূহল সব সময় ভয়কে অতিক্রম করে। তাঁর বেলাতেও তাই হল। তিনি কৌতূহলী হয়েই উঁকি দিলেন। ওয়েটিং রুমের ইজ চেয়ারে একজন বৃদ্ধ হলুদ কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। বৃদ্ধের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করে সিগারেট টানছে। মিসির আলি ঘরে ঢুকলেন। বৃদ্ধ চোখ মেলল না, তবে তার ঠোঁটের কোনায় সামান্য হাসি দেখা গেল। শরীর জমিয়ে দেওয়া তীব্র ভয় মিসির আলিকে আবারো আচ্ছান্ন করল। তিনি প্ৰায় ছিটকে বের হয়ে এলেন। বাকি রাতটা কাটালেন প্ল্যাটফরমে পায়চারি করে। এগার সিন্ধুর এক্সপ্রেস ভোর চারটা চল্লিশে প্ল্যাটফরমে ইন করল। মিসির আলি ট্রেনে ওঠার আগে আরেকবার ওয়েটিং রুমে উঁকি দিলেন। বৃদ্ধ যাত্রী ঠিক আগের জায়গাতেই আছে। মাথা নিচু এবং চোখ বন্ধ করে আগের মতোই সিগারেট টানছে। ঠোটের কোনায় আগের মতোই অস্পষ্ট হাসি।
মিসির আলি তার জীবনের এই ভয় পাওয়া ঘটনাকে নানা ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। সবচেয়ে কাছাকাছি ব্যাখ্যা যেটা দাঁড় করিয়েছিলেন সেটা হল কিশোর বয়সে তিনি নিশ্চয়ই নির্জন স্টেশনের ওয়েটিং রুমের কোনো ভূতের গল্প পড়ে ভয় পেয়েছিলেন। ভয়টা এতই তীব্র ছিল যে, মস্তিষ্কের নিউরোন সেই স্মৃতি মূল্যবান কোনো স্মৃতি মনে করে যত্ন করে মেমোরি-সেলে ঢুকিয়ে রেখেছে। নষ্ট হতে দেয় নি। অনেককাল পরে আরেকটি নির্জন স্টেশন দেখামাত্র মস্তিষ্ক মনে করল এ রকম একটা স্মৃতি তো আছে। স্মৃতিটা বের করে বর্তমানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যাক। যেহেতু অনেকদিনের স্মৃতি, বের করতে গিয়ে সমস্যা হল। স্মৃতির কিছু অংশ নষ্ট হয়ে গেল। কিছু অন্য রকম হয়ে গেল। মস্তিষ্ক শুধু যে স্মৃতি বের করে আনল তা না, স্মৃতির মনে জড়িত ভয়ঙ্কর ভীতিও বের করে আনল। এ রকম কাণ্ডকারখানা মস্তিষ্ক মাঝে মাঝে করে। এর যেমন মন্দ দিক আছে, ভালো দিকও আছে। মস্তিষ্কের ভেতর হঠাৎ নিউরোনের প্রবল ঝড় সৃষ্টি হয়। এতে ক্ষতিকারক স্মৃতি উড়ে চলে যায়। স্মৃতি জমা করে রাখা মেমরি-সেল খালি হয়।
আজ যে ভয়টা পাচ্ছেন তার পেছনের কারণটা কী? তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। পাচিলঘেরা প্ৰকাণ্ড একটা বাড়ির গেটের কাছে। অন্ধকারে পঁচিল-ঘেরা বাড়িটাকে জেলখানার মতো লাগছে। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন একা। এতক্ষণ লিলি তার সঙ্গে ছিল। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করে সে দারোয়ান শ্রেণীর কাউকে দিয়ে গেট খুলিয়েছে।
তাও পুরো গেট না। গেটের অংশ যার ভেতর ছোটখাটো মানুষ হয়তো বা কষ্ট করে ঢুকতে পারে। গেট খুলতেই লিলি তাঁর দিকে ফিরে বলল, স্যার আপনি দাঁড়ান। পঁচিছয় মিনিট লাগবে! আমি কুকুর বেঁধে আসি। আমাদের তিনটা কুকুর আছে। খুবই উগ্র স্বভাব, অপরিচিত কাউকে দেখলে কী করবে কে জানে? আমাকেই একবার কামড়ে দিয়েছিল।
মিসির আলি তারপর থেকে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি ঘড়ি দেখেন নি। কিন্তু তাঁর কাছে মনে হচ্ছে পাঁচ-ছ মিনিটের অনেক বেশি সময় পার হয়েছে। কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। বিশাল বাড়ি কিন্তু পুরোপুরি নিঃশব্দ। তিনটা ভয়ঙ্কর কুকুর অথচ তারা একবারও শব্দ করবে না এটা কেমন কথা? তাছাড়া বাড়ি অন্ধকারে ড়ুবে আছে। বিশাল এই বাড়ির একটি ঘরেও বাতি জ্বলবে না, এটাইবা কেমন কথা! এমন তো না যে, এই বাড়িতে মানুষজন থাকে না। রাত তো বেশি হয় নি। খুব বেশি হলে দশটা। যে দারোয়ান গেট খুলেছে তার হাতে কি একটা টর্চ থাকবে না?
এমন গাঢ় অন্ধকার মিসির আলি অনেকদিন দেখেন নি। নক্ষত্রের আলো পর্যন্ত নেই। আকাশ মেঘে ঢাকা। প্ৰবল অন্ধকারে জোনাকি বের হয়। জোনাকিও নেই। অনেকদিন তিনি জোনাকি দেখেন নি। জোনাকি দেখতে পেলে ভালো লগত।
নদীর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। স্রোতের শব্দ। হঠাৎ করেই কি নদী সাড়াশব্দ শুরু করলঃ এতক্ষণ এই নদী ছিল কোথায়? বকুল ফুলের গন্ধ আসছে। এটা কি বকুল ফুলের সময়? শহরবাসী হয়ে ছোটখাটো ব্যাপারগুলি ভুলতে বসেছেন। গন্ধটা হয়তো বকুল ফুলের না। অন্য কোনো বুনো ফুলের। জায়গাটা বন তো বটেই। আশপাশে লোকালয় 6न्छे!