মিসির আলি বললেন, কুয়ার ভয়। গৌর কালীমূর্তি এসে স্বপ্নে তোমাকে বলে গেল কখনো যেন কুয়ার পাশে না যাও। কুয়াতে ভয়ঙ্কর কিছু তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। গৌর কালী বলে তো কিছু নেই। তোমার অবচেতন মন গৌর কালীকে সৃষ্টি করেছিল। সেই অবচেতন মনই ভয়টাকেও সৃষ্টি করেছে। সেই ভয় বাস করছে কুয়ার ভেতরে। আমি যুক্তি দিয়ে কথা বলছি তুমি কি যুক্তিগুলি বুঝতে পারছ?
পারছি।
কুয়ার পাশে যেই মুহুর্তে তুমি দাঁড়াবে প্রবল ভয় তোমাকে সম্পূর্ণ গ্ৰাস করবে। অবচেতন মন তোমাকে ভয়ঙ্কর কিছু দেখাবে। কী দেখবে আমি জানি—হয়তো দেখবে কুয়ার গা বেয়ে ইদারিশ মাস্টার উঠে আসছে। তাকে দেখাচ্ছে একটা কুৎসিত মাকড়সার মতো। কিংবা এর চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু দেখাবে।
সুলতান হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে শান্ত গলায় বলল, আপনি যা বলছেন ঠিক আছে। আমি সেটা জানি। জানি বলেই কখনো কুয়ার পাশে যাই না। কারো পক্ষেই আমাকে কুয়ার পাশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না।
তোমার কাছে চলে আসবে। তুমি বসে আছ বেদিতে, তুমি দেখবে কুয়া ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তোমার দিকে।
সুলতান তীক্ষ্ণ গলায় বলল, তার মানে?
মিসির আলি বললেন, তুমি আকাশের তারা দেখ—এই ব্যাপারটি তুমি সবচেয়ে ভালো বুঝবে। আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হয় না আকাশের তারা নিচে নেমে আসছে। অনেকটা সে রকম। দৃষ্টি বিভ্রম। কুয়া থাকবে কুয়ার জায়গায় অথচ তোমার মনে হবে কুয়া জীবন্ত প্রাণীর মতো এগিয়ে আসছে।
সুলতান চাপা গলায় বলল, আপনি আমার সঙ্গে একটা ট্রিকস করার চেষ্টা করছেন। মিসির আলি বললেন, হ্যাঁ করছি। তোমার মনের গভীরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা ভয়টাকে বের করে এনেছি। ভয়ে তোমার চেতনা যখন অসাড় হয়ে এসেছে তখন বলেছি কুয়া এগিয়ে আসছে। তোমার অবচেতন মন তা গ্ৰহণ করেছে। একে সাইকোলজির ভাষায় বলে induced hallucination. তোমার চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারছি তুমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছ কুয়া তোমার দিকে এগিয়ে আসছে। তোমার মনও আমাকে খানিকটা সাহায্য করেছে। এই কুয়াটার প্রতি তোমার তীব্র আকর্ষণ। তুমি সব সময় তার কাছে যেতে চেয়েছ। কিছুক্ষণের ভেতর কুয়াটাকে তুমি তোমার সামনে এসে দাঁড়াতে দেখবে। তোমার ইচ্ছা করবে না, তারপরেও তুমি উঁকি দেবে—এবং যে ভয় তুমি পাবে সেই ভয়ের জন্ম এই পৃথিবীতে নয়। অন্য কোনো জগতে।
সুলতান চিৎকার করে উঠল, স্টপ, প্লিজ স্টপ। স্টপ ইট প্লিজ।
সুলতান বিকৃত গলায় চেচাচ্ছে। তার মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে শুরু করেছে। ছুটে এসেছে লিলি। কিছুদূর এসেই সে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। সুলতান চিৎকার করেই যাচ্ছে। সে থরথর করে কাঁপছে। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মরিচ ফুলের গাছের বেদির দিকে। ভয়ঙ্কর কিছু সে অবশ্যই দেখতে পাচ্ছে।
মিসির আলি শান্ত ভঙ্গিতে সিগারেট ধরালেন। এগিয়ে গেলেন মন্দিরের দিকে। সালমা মেয়েটি নিশ্চয়ই মন্দিরে আছে। বেচারি হয়তো ভয়েই মরে যাচ্ছে! তাঁর ভয়টা কাটানো দরকার।
সালমা মূর্তির আড়ালে গুটিসুটি মেরে বসে ছিল। মিসির আলিকে দেখে সে চোখ বড় বড় করে তাকাল। মিসির আলি কোমল গলায় বললেন, কেমন আছ গো মা? মেয়েটা জবাব দিল না। তার চোখ ভর্তি হয়ে গেল পানিতে।
মিসির আলি বললেন, আমার ছোট্ট মায়ের চোখে পানি কেন? কাছে এস চোখ মুছিয়ে দেই। এস জোনাকি পোকা দেখি। আমি আমার জীবনে এক সঙ্গে এত জোনাকি দেখি নি।