মিসির আলি খাতা বন্ধ করলেন। তাঁর মাথায় সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছেন সালমা নামের মেয়েটি আজ রাতেই মহাবিপদে পড়তে যাচ্ছে। সুলতান তার বিখ্যাত পরীক্ষা সালমাকে নিয়ে করছে না। সে পরীক্ষাটি করছে মিসির আলি নামের একজনকে নিয়ে যাকে সে মানসিকভাবে নিজের কাছাকাছি ভাবছে। মিসির আলি মোটামুটি নিশ্চিত যে সুলতান মধ্যরাতে এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটাবে তাকে ভয় দেখানোর জন্যে। বাচ্চা একটি মেয়ের মানসিক পরিবর্তন নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। সালমা মেয়েটি তার সাবজেক্ট না। তার সাবজেক্ট মিসির আলি। মেয়েটির মৃত্যুতে তার কিছু যায় আসে না। তার আগ্রহ কৌতূহল মিসির আলিকে নিয়ে। যে কারণে সালমা মেয়েটিকে যোগাড় করার পরই মিসির আলি নামের মানুষটাকে এখানে আনার জন্যে ব্যবস্থা করেছে। সুলতানের মতো মানুষেরা একটা পৰ্যায়ে বুদ্ধির খেলা খেলতে চায়। আমিই শ্ৰেষ্ঠ এটা প্রমাণ করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এটা তাদের একটা খেলা। শিশুদের সঙ্গে সিরিয়াল কিলারদের কোথায় যেন সামান্য মিল আছে। শিশুদের কাছে যেমন সবই খেলা এদের কাছেও তাই।
সালমা মেয়েটিকে রক্ষা করার কোনো উপায় কি আছে? খুব ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে এবং অতি দ্রুত ভাবতে হবে। হাতে সময় খুব বেশি নেই। সুলতানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে তিনি নামতে পারছেন না। মানসিক যুদ্ধ অবশ্যই করা যাবে কিন্তু তার জন্যে প্রয়োজনীয় অস্ত্ৰ কি তার কাছে আছে?
সুলতানের বিষয় অংক। কাজেই যুক্তি ব্যাপারটা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হবার কথা। যুক্তির ক্ষমতার প্রতি তার আস্থা অবশ্যই থাকবে। সুলতানের মানসিক দুর্গে তাকে পৌঁছতে হবে যুক্তির সিঁড়িতে পা রেখে। এমন যুক্তি যা সুলতানকে গ্রহণ করতে হবে। তিনি কি পারবেন? মিসির আলি চোখ বন্ধ করে আছেন। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছেন। পারছেন না। তিনি অনুভব করলেন তাঁর শরীর কাঁপছে। এটা ভালো লক্ষণ না। এটা বয়সের লক্ষণ। জরার লক্ষণ।
‘দিধ্বং নো অত জরসে নিনেষজ্
জরা মৃত্যুবে পরি নো দদাত্যথ
পক্কেন সহ সংভবেম’
আমার ভাগ্য আমাকে নিয়ে যাবে জরায়, জরা নিয়ে যাবে সেই মৃত্যুতে যা আমাকে অসীমের সঙ্গে যুক্ত করবে।
মিসির আলির ঘুম পাচ্ছে। তিনি বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন। তার শীত লাগছে। শীতে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। তিনি গায়ের উপর চাঁদ র টেনে দিলেন। তিনি কিছুক্ষণ ঘুমূবেন। মধ্যরাতের আগেই সুলতান নিশ্চয়ই তীকে ডেকে নিয়ে যাবে। হয়তো তখনি সালমার সঙ্গে দেখা হবে। হত্যাকাণ্ডটা যে খুব সহজ হবে তাও মনে হয় না। সুলতানের মতো মানুষেরা ড্রামা পছন্দ করে। হয়তো মেয়েটাকে স্নান করানো হবে। নতুন কাপড় পরানো হবে। গলায় দেওয়া হবে জবা ফুলের মালা। এই ফুল প্রাচীন ভারতের অনেক নারীরক্তের সাক্ষী। ঘুমের মধ্যে মিসির আলি বিড়বিড় করে বললেন, সালমা মাগো, ভয় পেও না। আমি আছি তোমার পাশে। আমি সাধারণ কেউ না মা, আমি মিসির আলি।
সুলতান মরিচ ফুল গাছের বেদিতে বসে আছে। তার সামনে হারিকেন। হারিকেনের আলোয় সুলতানের মুখ দেখা যাচ্ছে। আনন্দময় মানুষের মুখ। সে হাত দিয়ে মাথার চুল টানছে। কিন্তু তাতে কোনো অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে না। সুলতানের সামনে দুটা পিরিচে ঢাকা কফির মগ। মিসির আলি এসে বেদিতে বসলেন!। সুলতান কফির মগ মিসির আলির হাতে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, আমি এর মধ্যে দুবার খোঁজ নিয়েছিলাম! দেখলাম। আপনি ঘুমাচ্ছেন। স্যার আপনার ঘুম কি ভালো হয়েছে?
হ্যাঁ ভালো হয়েছে।
সুলতান হাসিমুখে বলল, এমন পরিস্থিতিতে কেউ ঘুমুতে পারে আমার ধারণা ছিল না।
মিসির আলি বললেন, পরিস্থিতি কি খুব খারাপ?
খারাপ তো বটেই, আজ অমাবস্যা না? আমি সালমা মেয়েটার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ও আসলে আমার পরীক্ষায় কোনো কাজে আসছে না। তাকে তো আর ফেরতও পাঠাতে পারি না। এই রিস্ক আমার পক্ষে নেওয়া সম্ভব না। কাজেই অন্য ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। কফি খেতে কেমন হয়েছে?
ভালো হয়েছে।
সালমা মেয়েটির সঙ্গে কি কথা বলবেন?
না।
না কেন?
মিসির আলি জবাব দিলেন না। কফির মাগে চুমুক দিতে লাগলেন। একবার তাকালেন মরিচ ফুল গাছটার দিকে। গাছ ভর্তি জোনার্কি। জুলছে, নিভছে। এত সুন্দর লাগছে দেখতে যে তিনি চোখ ফেরাতে পারছেন না।
স্যার কী দেখছেন?
জোনাকি। অনেকদিন পর জোনাকি দেখলাম। অপূর্ব দৃশ্য! মনে হচ্ছে আকাশের সব তারা গাছে নেমে এসেছে।
সুলতান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আপনি জোনাকি দেখে অভিভূত হচ্ছেন, মেয়েটিকে রক্ষা কীভাবে করা যায়। এই বিষয়ে ভাবছেন না?
ভাবছি। কোনো কিছুর দিকে তাকিয়ে থেকে অন্য কিছু ভাবা সহজ।
ভেবে কিছু পেয়েছেন?
হ্যাঁ।
কী পেয়েছেন? আচ্ছা আমিই বলি আপনি কী পেয়েছেন–আপনি ঠিক করেছেন যুক্তি দিয়ে আমার সিদ্ধান্ত বদলাবেন। আপনার বুলিতে যেসব ধারালো যুক্তি আছে তার সব একের পর এক করবেন। সক্রেটিসের বিখ্যাত যুক্তিটা দিতে পারেন। সক্রেটিস বলেছেন, কোনো মানুষই জেনেশুনে মন্দ কাজ করে না।
মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, এইসব যুক্তি তোমার বেলায় খাটবে না। তোমাকে যা করতে হবে তা হল—তোমার মনের ভেতরে, চেতনার গভীরে যে ভয় বাস করছে তাকে বের করে আনা।
সুলতান শীতল গলায় বলল, আমার ভেতরে ভয় বাস করছে? কীসের ভয়?