সুলতান হাসি মুখে তাকিয়ে রইল-জবাব দিল না। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে খুব মজার কোনো কথা শুনল।
মিসির আলি বললেন, তোমার স্ত্রী কোথায়? লিলি?
সুলতান হাই তুলতে তুলতে বলল, ও অসুস্থ।
মিসির আলি বললেন, তোমার পরীক্ষা নিরীক্ষায় লিলি সাহায্য করে না?
সুলতান বলল, ওর সাহায্যের তেমন প্রয়োজন পড়ে না! ও ভলেন্টিয়ার যোগাড় করে আনে। আপনাকে যেমন আনল। অবিশ্যি আপনাকে ভলেন্টিয়ার বলা ঠিক হচ্ছে না। বিপজ্জনক কাজে ভলেন্টিয়ার পাওয়া যায় না-জোর করে বানাতে হয়। আপনি অকারণে কথা বলে সময় নষ্ট করছেন। সালমার বিষয়ে কী লিখেছি তাড়াতাড়ি পড়ে ফেলুন। এক শ ছয় পৃষ্ঠায় পাবেন। আমি বরকতকে দিয়ে হারিকেন পাঠিয়ে দিচ্ছি। ভালো কথা চা খাবেন? আপনাকে আজ মনে হয়। বৈকালিক চা দেওয়া হয় নি। লিলি অসুস্থ হওয়ায় একটু সমস্যা হয়েছে। খাবারদাবারের ব্যবস্থাট খানিকটা এলোমেলো হয়েছে।
সুলতান উঠে দাঁড়াল। মিসির আলি হারিকেনের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। সালমার বিষয়ে কী লেখা আছে মন দিয়ে পড়তে হবে। মিসির আলি খাতা খুললেন। এক শ ছয় পৃষ্ঠা বের করলেন। এখনো ঘরে কিছু আলো আছে, পড়া শুরু করা যেতে পারে। এর মধ্যে নিশ্চয়ই হারিকেন চলে আসবে।
স্যাম্পল নাম্বার ৭
নাম : সালমা
বয়স : পনের থেকে ষোল
পড়াশোনা : নবম শ্রেণীর ছাত্রী
বুদ্ধি : ভালো। বেশ ভালো।
জীব হিসেবে মানুষকে যতটা ভঙ্গুর মনে করা হয় সে তত ভঙ্গুর না। মানুষের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করা কঠিন কাজ। মস্তিষ্কের ডিফেন্স ম্যাকানিজম প্রক্রিয়া অত্যন্ত প্রবল। মানসিক চাপ প্রতিরোধে সে তার সমগ্র শক্তি নিয়োগ করে। আমি অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে মানুষের এই ক্ষমতা অনেকবার প্রত্যক্ষ করেছি। সালমার বিষয়েও একই ব্যাপার ঘটেছে। তার উপর সৃষ্টি করা মানসিক চাপ সে নিজস্ব ডিফেন্স ম্যাকানিজমের মাধ্যমে প্রতিহত করছে! আমি প্রতিদিনের পর্যবেক্ষণ লিখে যাচ্ছি।
১৮.৪.৮০
সালমাকে প্রথম সংগ্রহ করা হল। সংগ্ৰহ পদ্ধতি অবান্তর বলে উল্লেখ করছি না। বাবা-মা-ভাই-বোন ছেড়ে হঠাৎ এই নতুন জায়গায় উপস্থিত হয়ে সে প্রথমে খুবই ঘাবড়ে গেল। আমি অতি দ্রুত তাঁর ভয় দূর করলাম। তাকে বলা হল আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার বাবা মাকে খুঁজে বের করে তাকে তাদের কাছে পাঠাব। মেয়েটি মিশুক প্রকৃতির। প্রাথমিক শঙ্কা ও ভয় সে দ্রুত কাটিয়ে উঠল। রাতে অনেকক্ষণ তার সঙ্গে গল্প করলাম। পড়াশোনার খোঁজ নিলাম। সে জানাল যে তার ভীতির বিষয় একটাই তা হল অংক। তার ধারণা সে এস.এস.সি.-তে সব বিষয়ে পাস করলেও অংকে ফেল করবে। আমি তার অংক ভীতি কাটানোর জন্যে অংক নিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করলাম। নয় সংখ্যাটির অদ্ভুত গুণ ব্যাখ্যা করলাম। যেমন ৯ এমন একটা সংখ্যা যাকে যে কোনো সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে এবং গুণফলের সাথে সংখ্যাগুলিকে যোগ করলে আবার ৯ হয়।
৯X৬=৫৪; ৫+৪=৯
৯X১৬=১৪৪; ১+৪+৪=৯
সালমা এতে খুবই মজা পেল। নিজেই ব্যাপারটা পরীক্ষা করল। এবং জানতে চাইল-৯-এর বেলায় এরকম কেন হচ্ছে? বোঝা যাচ্ছে মেয়েটির বুদ্ধি ভালো। অল্প বুদ্ধির মেয়ে অংকের এই ব্যাপারটা ধরতে পারত না।
১৯.৪.৮০
আজ সালমার উপর প্রথম মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হল। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম। সে কুমারী কি না। প্রথম কিছুক্ষণ প্রশ্নটা সে ধরতেই পারল না। তাকে কুমারী বলতে কী বোঝাচ্ছে তা ব্যাখ্যা করার পর সে হতভম্ব হয়ে গেল। সে কল্পনাও করে নি এ ধরনের কোনো প্রশ্ন আমি তাকে করতে পারি। সে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। আমি কঠিন ধমক দিয়ে তার কান্না থামিয়ে খুবই শান্ত গলায় বললাম যে তাকে এখানে আনা হয়েছে গৌর কালীর মন্দিরে দেবীর উদ্দেশে বলি দেওয়ার জন্যে। বলিদানের জন্যে কুমারী মেয়ে প্রয়োজন বলেই জিজ্ঞেস করা হচ্ছে।
তাকে দেবীমূর্তি দেখিয়েও আনলাম। সে জানতে চাইল কবে বলি দেওয়া হবে। আমি বললাম অমাবস্যায়। মেয়েটি সারারাত অচেতনের মতো পড়ে রইল। তার শরীরের উত্তাপ বাড়ল। রাতে ভুল বকতে থাকল।
২০.৪.৮০
সকালবেলা মেয়েটা আমার সঙ্গে খুবই স্বাভাবিক ব্যবহার করল এবং ভীত গলায় বলল-গত রাতে সে ভয়ঙ্কর একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছে। দুঃস্বপ্নে একজন কেউ তাকে এসে বলেছে যে তাকে মা কালীর কাছে বলি দেওয়া হবে। মেয়েটা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, চাচা এমন একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন কেন দেখলাম?
মেয়েটির নিজস্ব ডিফেন্স ম্যাকানিজম কাজ করতে শুরু করেছে। তার মস্তিষ্ক তাকে নিশ্চিতভাবে বুঝিয়েছে কাল রাতের ঘটনাটা দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছুই না।
দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পাওয়া যেতে পারে, তবে দুঃস্বপ্ন কেটে গেলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তার সময়টা স্বপ্ন এবং জাগরণী—এই দুইয়ের ভেতর ভাগ করে নিল। যখনই সে ভয় পাচ্ছে তখনি ভাবছে এটা স্বপ্ন, কিছুক্ষণের মধ্যে স্বপ্ন কেটে যাবে এবং সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
২১.৪.৮০
আজ সালমাকে রাতে থাকতে দেওয়া হল মন্দিরে। মন্দিরে সামান্য আলোর ব্যবস্থা রাখা হল। গাঢ় অন্ধকারে মানুষ ভয় পায় না। ভয় পাবার জন্যে আলো-আঁধার প্রয়োজন। কুকুর তিনটা মন্দিরের চারপাশে যেন ঘুরপাক খায় সেই ব্যবস্থা করা হল। মন্দিরের মূল দরজা খোলা। আমার দেখার ইচ্ছা মেয়েটি কী করে। সে তেমন কিছু করল না। সারারাত মূর্তির গা ঘেঁষে বসে রইল। মাঝে মাঝে দেখছি তার ঠোঁট নড়ছে। সে হয়তো কথা বলছে মূর্তির সঙ্গে। আমার ধারণা মূর্তিটাকে সে ভয়ঙ্কর হিসেবে না নিয়ে বন্ধু হিসেবে নিয়েছে। কারণ মূর্তিটা দেখতে লিলির মতো। সালমা লিলিকে চেনে! মূর্তির গা ঘেঁষে বসে থাকার এই একটিই যুক্তি। তাকে অবিশ্যি অমাবস্যা কবে তা জানানো হয়েছে। অমাবস্যার মধ্যরাতে ঘটনা ঘটানো হবে তাও বলা হয়েছে। জেমস হাউলারের বিখ্যাত পরীক্ষার মতো পরীক্ষা। তার পরীক্ষার বাক্সে পানি জমতে শুরু করেছে। আমার পরীক্ষায় অমাবস্যা এগিয়ে আসছে। হা হা হা।