না সম্ভব না।
কিছু নিশ্চয়ই বলা সম্ভব। এই যে আমি বললাম–তিনি আকাশের তারা দেখেন। এই বাক্যটায় আমি সম্মানসূচক তিনি ব্যবহার করেছি। এখান থেকেই তো আপনি বলতে পারবেন যে, আমার স্বামীর বয়স বেশি। সমবয়সী হলে বলতাম, ও আকাশের তারা দেখে।
মিসির আলি নড়েচড়ে বসলেন। এই মেয়েটির সহজ সরল চোখের ভেতরে তীক্ষ্ণ চোখ লুকিয়ে আছে। এই চোখকে অগ্রাহ্য করা ঠিক না।
কেরোসিনের চুলা কিনতে চাচ্ছেন কেন?
আমি কয়েক দিনের জন্যে বাইরে যাব। নিজে রান্নাবান্না করে খেতে হবে। তার প্ৰস্তুতি।
শুধু কেরোসিনের চুলা কিনলে হবে না। এর সঙ্গে আরো অনেক কিছু কিনতে হবে। কী কী কিনতে হবে আসুন তার একটা লিস্ট করে ফেলি। এতে দ্রুত সময় কেটে যাবে।
লিলি তার হ্যান্ডব্যাগ খুলে কাগজ কলম বের করুল। মিসির আলিকে অবাক করে দিয়েই টেবিলে ঝুঁকে দ্রুত লিখে ফেলল–
১. কেরোসিনের চুলা
২. চুলার ফিতা
৩. কেরোসিন
৪. ছুরি
৫. কাঠের বোর্ড (মাছ গোশত কাটার জন্যে)
৬. কেতলি
৭. সসপ্যান
৮. দুটি হাঁড়ি (ভাতের এবং তরকারির)
৯. চায়ের কাপ
১০. চামচ
১১. কনডেন্সড মিল্ক
১২. চা
১৩. কফি
মেয়েটা এমনভাবে লিখছে যেন মিসির আলি চেয়ারে বসে পড়তে পারেন। মেয়েটার এই ভঙ্গিটা ভালো লাগছে। কাজের ভঙ্গি। কাজটা সে হেলাফেলার সঙ্গে করছে। না, গুরুত্বের সঙ্গে করছে।
আপনি এক যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
আমারও মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছা করে একা কোথাও গিয়ে থাকতে। রবিনসন ক্রুশোর মতো একা কোনো দ্বীপে বাস করা। কী করব না করব কেউ দেখবে না। আমার মনে হয়। আমি একা এক সারা জীবন কাটাতে পারব। আচ্ছা চাচাজী আপনি কি পারবেন?
বুঝতে পারছি না। আমি কখনো ভেবে দেখি নি।
কোনো পুরুষ মানুষের পক্ষে এক একা সারা জীবন কাটানো সম্ভব না। পুরুষদের নানান ধরনের চাহিদা আছে। ভদ্র চাহিদা, অভদ্র চাহিদা। ওদের চাহিদার শেষ নেই।
মেয়েরা কি তার থেকে মুক্ত?
মেয়েরাও তার থেকে মুক্ত না। তবে মেয়েরা ব্যক্তিগত চাহিদার কাছে কখনো পরাজিত হয় না। পুরুষরা হয়।
লিলি লেখা বন্ধ করে সোজা হয়ে বসতে বসতে বলল, সব মিলিয়ে আটত্রিশটা আইটেম লিখেছি। এই আটত্রিশটা আইটেম সঙ্গে নিয়ে গেলে আপনি একা একা থাকতে পারবেন। এর মধ্যে অষুধও আছে। চট করে অসুখবিসুখ হলে ডাক্তারখানা পাবেন না।
থ্যাংক য়্যু। আমি কাল আবার আসব। এর মধ্যে যদি আরো নতুন কোনো আইটেমের নাম মনে আসে আপনাকে বলব।
আচ্ছা।
লিলি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, এখন একটা বেজে দশ মিনিট। এই নিন চিঠি। দয়া করে ঝুড়িতে ফেলে দেবেন না। পড়বেন। তবে আমার সামনে পড়বেন না। আমি চলে যাবার পর পড়বেন।
অবশ্যই পড়ব।
আমি বাজার করতে খুব পছন্দ করি। আপনি যদি রাজি হন তাহলে কাল যখন আসব তখন আপনাকে নিয়ে কেরোসিনের চুলাটুলা কিনে দেব। আপনি যে দামে কিনবেন, আমি তার অর্ধেক দামে কিনে দেব। আর কিছু আইটেম আছে যা দোকানে গেলে মনে পড়বে। কাগজ কলম নিয়ে বসলে মনে পড়বে না। এই তো এখন একটা জরুরি। আইটেম মনে পড়ল, ন্যাকড়া।
ন্যাকড়া?
হ্যাঁ ন্যাকড়া। ন্যাকড়াকে মোটেই তুচ্ছ মনে করবেন না। চুলা থেকে গরম চায়ের কেতলি নামাবেন কীভাবে? হাতের কাছে ন্যাকড়া না থাকলে হয়তো গায়ের শার্টের একটা অংশ দিয়ে নামাতে যাবেন-তারপর এ্যাকসিডেন্ট। সারা গা গেল পুড়ে। ভালো কথা অষুধের লিষ্টে আমি বার্নল লিখে দিয়েছি। নিতে কিন্তু ভুলবেন না।
আচ্ছা ভুলব না।
চাচাজী বাজার করার সময় আমাকে কি আপনি সঙ্গে নেবেন?
তুমি কাল আসি তখন দেখা যাবে। আমার সমস্যা কি জান? আমি আমার নিজের কাজগুলি নিজেই করতে ভালবাসি। কেউ আমাকে কোনো ব্যাপারে সাহায্য করছে এটা ভাবতেই আমার কাছে খারাপ লাগে।
এই জন্যেই কি বিয়ে করেন নি?
বিয়ে না করার পেছনে এটা কারণ হিসেবে কাজ করে নি। বউকে দিয়ে কাজ করাব-এই ভেবে তো আর কেউ বিয়ে করে না।
কাল আমি ঠিক এগারটার সময় আসব।
আচ্ছা।
আমার যেতে ইচ্ছা করছে না। আরো কিছুক্ষণ আপনার সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছা করছে। বসব?
না। আমি একনাগাড়ে কারো সঙ্গেই পঞ্চাশ মিনিটের বেশি গল্প করতে পারি না। দীর্ঘদিন মাষ্টারি করেছি। তো। মাষ্টারদের ক্লাসগুলি হয় পঞ্চাশ মিনিটের। যে সব শিক্ষক দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন তারা কখনো পঞ্চাশ মিনিটের বেশি কোনো সিটিং দিতে পারেন না।
আমার নাম কি আপনার মনে আছে?
মনে আছে। ডাক নাম লিলি। ভালো নাম মারহাবা খাতুন।
আমার ভালো নাম আসলে মারহাবা খাতুন না। মাহাবা বেগম। আমি মার পরে একটা র বসিয়ে মাহাবাকে মারহাবা করেছি।
মাহাবা তো বেশ আধুনিক নাম। তুমি কেন বললে খুব পুরোনো ধরনের নাম?
মিথ্যা করে বললাম। ছোট্ট একটা পরীক্ষা করলাম। মিথ্যা কথা বললে আপনি ধরতে পারেন কি না সেই পরীক্ষা। আমি আপনাকে নিয়ে লেখা একটা বইয়ে পড়েছি কেউ মিথ্যা কথা বললে আপনি সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলেন। আসলে আপনি পারেন না।
তুমি নাম নিয়ে মিথ্যা বলতে পার এটা মাথায় আসে নি। কাজেই আমি সেইভাবে তোমাকে লক্ষ করি নি।
মেয়েদের সম্পর্কে আপনি আসলে খুব কম জানেন। নিজের নাম নিয়ে মিথ্যা কথা বলতে মেয়েরা খুব পছন্দ করে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। ধরুন কোনো মেয়ে টেলিফোন ধরেছে। অপরিচিত একজন পুরুষ জিজ্ঞেস করুন, আপনি কে বলছেন? মেয়েটা তখন নিজের নাম না বলে ফট করে তার বান্ধবীর নাম বলে দেবে। আচ্ছা। আমি যাই, আপনি তো আবার পঞ্চাশ মিনিটের বেশি কথা বলেন না। আমি যে বাড়তি কিছুক্ষণ কথা বললাম-কেন বললাম জানেন? পঞ্চাশ মিনিট পুরো করার জন্যে বললাম। আমি আপনার কাছে এসেছি। সাড়ে বারোটায়। এখন বাজছে একটা বিশ। পঞ্চাশ মিনিট হয়েছে?