আমি বললাম, আপনি মাকড়সা দুটা ফেলে দিন। আপনার পায়ে পড়ি।
নারীমূর্তি বলল, পায়ে পড়ে লাভ হবে না। আমি মাকড়সা হাত দিয়ে ছোব না। স্নান করে এসেছি। হাত নোংরা হবে। তুই মাকড়সার দিকে না তাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কথা বল। তাহলে ভয় কমবে।
আমি বললাম, আপনি কে?
নারীমূর্তি চাপা গলায় বলল, আমি গৌর কালী। কী আশ্চর্য তুই তো দেখি মাকড়সার ভয়ে মরেই যাচ্ছিস! পেচ্ছাব করে মন্দিরও অপবিত্র করে ফেলেছিস। তুই কেমন ছেলে বল দেখি। মাকড়সার ভয়ে কেউ পেচ্ছাব করে? ছিঃ!
আমি বললাম, আপনি একটা কাঠি দিয়ে মাকড়সা দুটা ফেলে দিন।
নারীমূর্তি চাপা হাসি হাসতে হাসতে বলল-পাগলের মতো কথা বলবি না। আমি এখন কাঠি পাব কোথায়? কাঠি খুঁজতে হলে মন্দিরের বাইরে যেতে হবে। কুয়ার পাড়ে তোর মাস্টার বসে আছে। আমি নেংটো হয়ে তার সামনে যাব নাকি? তোকে একটা বুদ্ধি দেই শোন–এই মাস্টার তোকে আরো অনেক যন্ত্রণা দেবে। যন্ত্রণা দেবার আগেই ব্যবস্থা করে ফেল।
কী ব্যবস্থা?
মাস্টারকে প্রায়ই দেখি কুয়ার ওপর বসে থাকে। আচমকা ধাক্কা দিয়ে ব্যাটাকে কুয়ার ভেতর ফেলে দিবি। পারবি না?
না।
না পারার কী আছে? এক ধাক্কায় সব সমস্যার সমাধান। খুবই গহিন কুয়া। নিচে বিষাক্ত গ্যাস। একবার পড়লে আর দেখতে হবে না। কাজটা যে তুই করেছিস সেটাও কেউ বুঝবে না। ভাববে নিজে নিজে পড়ে গেছে। আমার অবিশ্যি ধারণা কেউ কোনোদিন জানবেও না যে এইখানে একজন মানুষ পড়ে আছে।
মন্দিরের ভেতরের স্মৃতি। এরপর আমার কিছু মনে নেই। হয়তো আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। এই ঘটনার তৃতীয় দিনের দিন আমি মুহম্মদ ইদরিশ মাস্টারকে ধাক্কা দিয়ে কুয়ায় ফেলে দেই। কুয়াটা খুব গভীর তো বটেই, ধাক্কা দেওয়ার অনেক পরে ঝপাং শব্দটা কানে আসে। ও আল্লাগো ও আল্লাগো শব্দটি দুবার শোনা যায়। তারপর সব নিস্তব্ধ। আমি খুব স্বাভাবিকভাবে কুয়ার পড়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁট করি। তারপর ঘরে চলে আসি।
মাস্টার সাহেব বাড়িতে নেই এটা নিয়ে বাড়ির কাউকেই উদ্বিগ্ন হতে দেখা গেল না-কারণ তখন আমার মায়ের শরীর খুবই খারাপ। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এখন মারা যান তখন মারা যান অবস্থা। মওলানা ডাকা হয়েছে। মওলানা তওবা করিয়েছেন। খবর পেয়ে বাবা চলে এসেছেন ঢাকা থেকে। মা সেই যাত্রা রক্ষা পেয়ে যান। বাবা উৎফুল্ল মনে ঢাকায় ফিরে যান। যাবার আগে আরেকজন নতুন মাস্টার ঠিক করে যান। মুহম্মদ ইন্দরিশের বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে সে ভালো কোনো সুযোগ পেয়ে চাকরি ছেড়ে ঢাকায় চলে গেছে। নিমকহারাম টিমকহারাম বলে তাকে অনেক গালাগালিও করেন।
মার শরীর আরেকটু ভালো হলে আমরা আবার ঢাকা শহরে চলে আসি। মুহম্মদ ইন্দরিশ কুয়ার ভেতরে থেকে যায়। তার বিষয়ে কেউ কিছুই জানে না। আমি নিজেও ব্যাপারটা ভুলে যাই। একবার শুধু রাতে মন্দিরে দেখা নারীমূর্তিকে স্বপ্নে দেখি। স্বপ্নটা এ রকম-আমি মন্দিরের বারান্দায় বসে পেয়ারা খাচ্ছি। নারীমূর্তি এসে আমার সামনে দাঁড়াল। পরিচিত ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বলল, এই বাঁদর! আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি বললাম চিনতে পারছি।
অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলছিস কেন? নাকি আমার গায়ে কাপড় নেই বলে। তাকাতে লজ্জা লাগছে?
আমি বললাম, লজ্জা লাগছে।
চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বল তাহলে লজ্জা লাগবে না। এখন বল দেখি ইদারিশ মাস্টারের উচিত শিক্ষা হয়েছে না?
আমি বললাম, হয়েছে।
দেখলি কেউ কিছু বুঝতে পারে নি।
হুঁ।
মানুষের শরীর পচে গেলে খুবই দুৰ্গন্ধ হয়। কুয়াটা তো অনেক গভীর। এই জন্যে পচা গন্ধ নিচে জমে আছে উপরে আসতে পারছে না। বুঝতে পারছিন্স?
হুঁ।
আমি তোকে একটা বিষয়ে সাবধান করতে এসেছি।
কোন বিষয়ে?
তুই কুয়ার ধারে একা একা যাবি না।
গেলে কী হবে?
ইদরিশ মাস্টার তোকে ডাকবে। তুই বাচ্চা মানুষ তো। ডাক শুনে ভয়টয় পেতে পারিস।
আচ্ছা কুয়ার ধারে যাব না।
কখনো কোনোদিনও কুয়ার ভেতরে কী আছে। উঁকি দিয়ে দেখতে যাবি না। দেখতে গেলেই মহাবিপদ।
আচ্ছা দেখতে যাব না।
ইদারিশ মাস্টারের প্রসঙ্গ এইখানেই শেষ। অনেক বছর পর ইদারিশ মাস্টারর প্রসঙ্গটা আমার আবার মনে আসে। তখন আমি বিলেতে পড়াশোনা করছি। কোনো এক। উইক এন্ডে হঠাৎ একটা বই হাতে এল-বইটার নাম The crystad door, বইটার লেখক কিংস কলেজের একজন বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট-James Hauler, তিনি এই বইটিতে বললেন-মানুষের মনের কিছু দরজা আছে যা সহজে খোলে না। মানুষ যদি কোনো কারণে ভয়ঙ্কর কোনো চাপের মুখোমুখি হয় তখনি দরজা খুলে যায়। তিনি এই দরজার নাম দিয়েছেন crystal door.
জেমস হাউলার বলছেন–এই স্ফটিক দরজার সন্ধান বেশির ভাগ মানুষ সমগ্র জীবনে কখনো পায় না। কারণ বেশির ভাগ মানুষকে তীব্র ভয়াবহ মানসিক চাপের মুখোমুখি হতে হয় না। জেমস হাউলার মনে করেন মানুষের কাছে দুধরনের বাস্তব আছে। একটি দৃশ্যমান জগতের বাস্তবতা, আরেকটি অদৃশ্য জগতের বাস্তবতা। স্বপ্ন হচ্ছে সে রকম একটি অদৃশ্য জগত এবং সেই জগতও দৃশ্যমান জগতের মতোই বাস্তব। স্ফটিক দরজা বা crystal door হল অদৃশ্য বাস্তবতার জগতে যাবার একমাত্র দরজা। এই সাইকিয়াট্রিষ্ট মনে করেন যে কৃত্রিম উপায়ে মানুষের মনে চাপ সৃষ্টি করে অদৃশ্য দরজা খোলা যেতে পারে। তিনি একটি কৃত্রিম উপায় বেরও করেছেন। তার উপর গবেষণা করছেন।