মিসির আলি বললেন, তুমি কি মানুষ খুন করেছ?
সুলতান জবাব দিল না।
মিসির আলি বসে স্তব্ধ হয়ে আছেন। সুলতান হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছে। পেয়ারা গাছের নিচে বরকতকে দেখা যাচ্ছে সে কুকুরকে গোসল দিচ্ছে।
রোদ উঠেছে। আবহাওয়া অত্যন্ত মনোরম। চেরী গাছ থেকে একটা দুটা করে ফুল পড়ছে। ফুলগুলি গাছে যত সুন্দর দেখাচ্ছে—হাতে নেওয়ার পর তত সুন্দর লাগছে না। কিছু সৌন্দৰ্য দূর থেকে দেখতে হয়, কাছ থেকে দেখতে হয় না।
আমার নাম সুলতান
আমার নাম সুলতান।
সাধারণত গরিব ঘরের ছেলেমেয়েদের এ জাতীয় নাম থাকে। সুলতান, সম্রাট, বাদশাহ্। বাবা মা ভাবেন বড় হয়ে ছেলে রাজা বাদশাহ্ হবে। আমি কোনো গরিব ঘরের সন্তান ছিলাম না। বিত্তশালী পরিবোরর সন্তান ছিলাম। আমার বাবা মারি সন্তানদের নামকরণের মতো তুচ্ছ বিষয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না। আমরা অনেকগুলি ভাই-বোন ছিলাম। মা প্রতিবছর একটি করে সন্তান প্রসব করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। জ্ঞান হবার পর থেকেই মাকে বিছানায় শোয়া পেয়েছি। নিজের সন্তানদের দিকে ভাকানোর মতো অবস্থা তাঁর ছিল না। তাঁর মন এবং শরীর দুইই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। শেষের দিকে তিনি মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা শুরু করলেন।
আমরা থাকতাম পুরোনো ঢাকার একটা বাড়িতে। সেই বাড়িটিও বিশাল। সেই বাড়িও উঁচু পঁচিলে ঘেরা। আমাদের পড়াশোনার জন্যে ঢাকায় এনে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেই দিকে কারো নজর ছিল বলে মনে হয় না। বাবা ব্যস্ত তার ব্যবসা নিয়ে। আজ ঢাকা, কাল নারায়ণগঞ্জ, পরশু খুলনা এই অবস্থা। মা বিছানায়। বাড়ি ভর্তি কাজের লোক। এরা পান খেয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘোরাফেরা ছাড়া কিছু করে না। সন্ধ্যার পর দুজন প্রাইভেটটিউটর আসেন। তাঁরা চা পানি খান। বেত নিয়ে হান্বিতাম্বি করেন। সপ্তাহে তিন দিন আসেন। একজন মওলানা। তাঁর বিরাট দাড়ি, চোখে সুরমা। তিনি আমাদের কোরান শরীফ পাঠ করা শেখান। বিরাট বিশৃঙ্খলার ভেতরে আমরা বড় হচ্ছি। তবে বিশৃঙ্খলারও নিজস্ব ছন্দ আছে। কোথাও ছন্দ পতন হচ্ছে না। একদিন হল–আমার বড় বোন মারা গেল, ভালো মানুষ-সারাদিন কাজকর্ম করেছে। মওলানা সাহেবের কাছে সিপারা পড়েছে। রাতে এশার নামাজ পড়ে ঘুমুতে গিয়েছে, সেই ঘুম আর ভাঙল না।
বাবা তখন চিটাগাং-এ। তিনি খবর পেয়ে কাজকর্ম ফেলে চলে এলেন। তাঁকে কন্যা শোকে অধীর বলে মনে হল না, তিনি শুধু বারান্দার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হাঁটতে লাগলেন। আর বারবার বলতে লাগলেন-সমস্যাটা কী? ঘটনাটা কী?
বড় বোনের মৃত্যুর পেছনে কোনো সমস্যা বা ঘটনা হয়তো ছিল, আমি নিতান্তই শিশু বলে বুঝতে পারি নি। আমার বড় বোনের নাম মীরু। তার তখন আঠার উনিশ বছর। সমস্যারই সময়। আমার ধারণ ভালো কোনো সমস্যাই ছিল।
বড় বোনের মৃত্যুর ঠিক ছমাসের মাথায় মারা গেল আমার মেজো ভাই। তার নাম ইজাজত। স্কুল থেকে ফেরার পথে রিকশার ধাক্কা খেয়ে নর্দমায় পড়ে গিয়ে মাথায় ব্যথা পেল। বাসায় এসে কয়েকবার বমি করে চোখ উন্টে দিল। বাবা শোকে যে অভিভূত হলেন তা না, চোখ-মুখ কুঁচকে বললেন, সমস্যাটা কী? ট্রাকের নিচে পড়ে মারা যায় এটা ঠিক আছে। কিন্তু রিকশার নিচে পড়ে মৃত্যু এটা কেমন কথা? আর কিছু না অভিশাপ লেগে গেছে। মহাঅভিশাপ লেগে গেছে। এই বাড়িতে থাকা আর ঠিক হবে না।
সেই বছরের শেষ দিকে আমার সবচেয়ে ছোট বোনটি মারা গেল। তার মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই হয়েছিল বলা চলে। ডিপথেরিয়ায় মৃত্যু। ছোটবোনের মৃত্যুর পর বাবা সবাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। ঠিক হল ঢাকায় নতুন কোনো বড় বাড়ি ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আমরা গ্রামে থাকব। অভিশাপ লাগা বাড়িতে ফিরে যাব না। গ্রামের বাড়িতে আমাদের লেখাপড়া দেখিয়ে দেবার জন্যে সাৰ্বক্ষণিক একজন শিক্ষক রাখা হল তার নাম ইদারিশ। মুহম্মদ ইদারিশ মাস্টার। বাবা তাঁকে ডেকে বিশেষ নির্দেশ দিয়ে দিলেন–শিশুদের শাসনে রাখতে হবে। কঠিন শাসন। পড়াশোনা না করলে, বেয়াদবি করলে মেরে তক্তা বানিয়ে দেবে। কোনো অসুবিধা নেই। শিশুদের দুইটাই অষুধ। একটা কৃমির অষুধ, আরেকটা মার।
মুহম্মদ ইদারিশ অত্যন্ত উৎসাহে তাঁর কর্মকাণ্ড শুরু করলেন। প্রতিদিনই তিনি নির্যাতনের নানান কৌশল বের করতে লাগলেন। দুই হাতে ইট নিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকা দিয়ে শুরুটা করলেন। হাতের ইট তাঁর পায়ে ফেলে দিয়ে তাঁকে প্রায় খোঁড়া করে ফেলার চেষ্টা করেছিলাম বলেই হয়তো আমার শাস্তির ব্যাপারে তিনি বিশেষ যত্নবান হলেন। এমন সব শাস্তি যা অনেক চিন্তা-ভাবনা, গবেষণা করে বের করতে হয়। চট করে মাথায় আসে না।
আমাকে তিনি এক বিকালে বিশেষ এক ধরনের শাস্তি দেবার জন্যে মন্দিরে নিয়ে ঢুকলেন। গা থেকে শার্ট খুলে খালি গা করলেন। দড়ি দিয়ে দুই হাত পেছনমোড়া করে বাঁধলেন। তারপর দুটা প্ৰকাণ্ড বড় মাকড়সা সুতা দিয়ে বেঁধে আমার গলায় মালার মতো পরিয়ে দিয়ে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে চলে গেলেন।
আমার মাকড়সা ভীতি আছে। এই নিরীহ প্রাণী মানুষের কোনোই ক্ষতি করে না। কিন্তু যারা একে ভয় পায় তাদের কাছে এরা রাজ্যের বিভীষিকা নিয়ে উপস্থিত হয়। যে কারণে মাকড়সা ভীতির আলাদা নাম পর্যন্ত আছে।
প্রথম কিছুক্ষণ আমার মনে হল আমি বোধহয় এক্ষুনি মারা যাব। সুতা দিয়ে বাধা মাকড়সা দুটা সারা গায়ে কিলবিল করছে। গলা বেয়ে মুখের দিকে উঠতে চেষ্টা করছে। আমি চিৎকার করার চেষ্টা করছি, গলা দিয়ে সামান্যতম শব্দও বের হচ্ছে না। আমার ইচ্ছা করছিল ছুটে গিয়ে দরজায় আছড়ে পড়ি। সেটা সম্ভব হচ্ছিল না, কারণ আমার হাত-পা জমে গিয়েছিল। ঘর অন্ধকার। আমি চোখে কিছুই দেখছি না, কিন্তু অদ্ভুত কারণে মাকসড়া দুটাকে দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে তাদের গা থেকে হালকা সবুজ আলো বের হচ্ছে। এই সময় অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল-চোখের সামনে দেখলাম একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ হাসি হাসি-যুবতী মেয়ে। তার গায়ে কোনো কাপড় নেই, তার জন্যে কোনো লজ্জাও নেই। তার মাথা ভর্তি লম্বা লম্বা চুল। সেই চুল মুখের উপর পড়ে আছে বলে মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটা বলল, মাকড়সা তো সামান্য পোকা। তুই ভয়ে দেখি মরে যাচ্ছিস?