আমাকে এখানে আটকে রেখে তোমার লাভ কী?
লাভ আছে। সাইকোলজি বিশেষ করে প্যারাসাইকোলজির উপর আপনার দখল অসাধারণ। আপনি আমার উপর গবেষণা করবেন। আমার মাথার ভেতর উঁকি দিয়ে দেখবেন সেখানে কী আছে। কেন আমি এ রকম?
তুমি কী রকম?
আপনার অনুমান শক্তি তো ভালো, আপনি অনুমান করুন। আপনাকে সামান্য সাহায্য করছি। আমার তুলনায় অশ্বিনী কুমার রায় একজন মহাপুরুষ। হা হা হা।
মিসির আলি তাকিয়ে আছেন। সুলতানও তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। সে এখন আর হাসছে না। কিন্তু হাসিটা শরীরের ভেতর আছে। কারণ তার শরীর কাঁপছে। মনের ছায়া চোখে নাকি পড়ে। চোখ হচ্ছে মনের জানালা। মিসির আলির মনে হল না-সুলতানের চোখে মনের কোনো ছায়া পড়েছে। শান্ত স্থির চোখ। যে চোখ বুদ্ধিতে ঝকমক করছে।
সুলতান বলল, স্যার আপনার কি ভয় লাগছে?
মিসির আলি বললেন, না।
সুলতান বলল, ভয় লাগছে না কেন?
বুঝতে পারছি না কেন।
সুলতান বলল, আপনি যে ভয় পাচ্ছেন না সেটা আপনাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে। ভয় পাবেন না জানলে আগেই আপনাকে বলতাম। যাই হোক আপনার উচিত আমাকে ধন্যবাদ দেওয়া।
কেন বল তো?
সুলতান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আপনাকে জীবনের শ্রেষ্ঠতম গবেষণার সুযোগটা আমি করে দিচ্ছি। একজন অতি ভয়ঙ্কর মানুষকে আপনি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। যে আপনার গবেষণায় আপনাকে সাহায্য করবে। আপনিও আমাকে কিছুটা সাহায্য করবেন।
আমি কী সাহায্য করব?
আমাকে সঙ্গ দেবেন। আপনার সঙ্গে বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্পকলা নিয়ে আলাপ করব। আকাশের তারা দেখব। তাছাড়া আমি নিজেও ছোটখাটো কিছু পরীক্ষা করছি। মানসিক পরীক্ষা। এই পরীক্ষাতেও আপনি সাহায্য করবেন। মনোজগতের যে পড়াশোনা আপনার আছে আমার তা নেই। পরীক্ষাটা ঠিকমতো হচ্ছে কি না। আপনি দেখে দেবেন।
কী পরীক্ষা?
সালমা নামের একটা মেয়ের কথা আপনাকে চিঠিতে লিখেছিলাম। তাকে নিয়েই পরীক্ষা। আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে, সব মানুষের ভেতরই অতীন্দ্ৰিয় ক্ষমতা আছে। মানুষের মনে ভয়ঙ্কর চাপ দিয়ে সেই ক্ষমতা বের করে আনা যায়। আমি সালমার উপর এই চাপটাই দিচ্ছি!
মেয়েটা কোথায়?
মেয়েটা এ বাড়িতেই আছে। রাতে আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব।
লিলি বলছিল সালমা বলে আলাদা কেউ নেই। লিলিই সালমা।
লিলির সব কথা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করার কিছু নেই। আমি এখন ঘুমুতে যাব। আপনার কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে জিজ্ঞেস করুন।
না, হুইল চেয়ারের আমার কোনোই প্রয়োজন নেই। আমি শারীরিকভাবে সুস্থ একজন মানুষ। ইচ্ছা করেই হইল চেয়ারে সময় কাটাই যাতে বাইরের লোকজন জানে।
এ বড়িতে পঙ্গু একজন মানুষ থাকে। পঙ্গু বলেই সে শহর ছেড়ে নির্জন বাস করে। এই কাজটা না করলে কথা উঠত সম্পূর্ণ সুস্থ একজন মানুষ দিনের পর দিন এই নির্জনে স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে আছে কেন? অবিশ্যি হুইল চেয়ারের একটা ভালো ব্যবহারও আছে। টেলিস্কোপ ফিট করে তারা দেখার সময় এটা খুব কাজে লাগে।
তুমি যে আমাকে এখানে আটকে রাখার জন্যে এনেছ তা কি এ বাড়ির লোকজন জানে?
জানবে না কেন? জানে। লিলি জানে, বরকত জানে। আপনার মতো অনেকেই এ বাড়িতে আসে। কেউ ফিরে যায় না। বুঝতেই পারছেন এ বাড়ি থেকে কাউকে জীবিত ফেরত পাঠানো আমার জন্যে সম্ভব না। কোনো ভয়ঙ্কর মানুষ যদি তার কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে চায় তাহলে অবশ্যই তাকে সাবধানী হতে হবে। সিরিয়াল কিলারদের কথাই ধরুন–সব সিরিয়াল কিলারই চিতাবাঘের চেয়েও সাবধানী। তাকে একের পর এক মানুষ মারতে হবে। সাবধানী না হলে এই কাজটা সে করতে পারবে না। স্যার আমি ঠিক বলছি?
হ্যাঁ ঠিক বলছ।
থ্যাঙ্ক যু। আমি সালমা মেয়েটিকে নিয়ে গবেষণাধর্ম যে কাজটা করেছি তা লেখার চেষ্টা করেছি। আমি পাঠিয়ে দেব। পড়ে দেখুন। লেখাটা গবেষণাধর্মী হয় নি। সায়েন্টিফিক পেপার কী করে লিখতে হয় জানি না। এই দায়িত্বটা আপনার। আমরা এই জঙ্গলে বসে একের পর এক রিসার্চ পেপার বিদেশী জার্নালে পাঠাব। মূল অথর আপনি আমি কো-অথর।
সুলতান হাসল। সেই হাসি যা চট করে মুখ থেকে মুছে যায়। কিন্তু শরীরে থেকে যায়। বেশ কিছুক্ষণ শরীর দুলতে থাকে। এই প্রথম মিসির আলির শরীর গুলিয়ে উঠল। তার কাছে মনে হল ঘেন্নাকর কিছু তার সামনে বসে আছে।
সুলতান বলল, স্যার এখন আপনি আমাকে সামান্য ভয় পাচ্ছেন। আপনার চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। কোস্পেনি হিসেবে আমি খারাপ হব না। আমি শিক্ষিত একজন মানুষ। অংকশাস্ত্রের মতো একটা জটিল বিষয়ে আপার পিএইচ. ডি. ডিগ্নি আছে। আপনি যদি অংকের ছাত্র হতেন তাহলে আমাকে চেনার সামান্য সম্ভাবনা ছিল–আমার পিএইচ. ডি.র কাজ খুব ভালো হয়েছিল। গ্রুপ থিওরির সব বইতেই সুলতান ফাংশন বলে একটা ফাংশানের উল্লেখ আছে। আমার নামে তার নাম। যৌবনে এই দিকে কিছু মেধা ব্যয় করেছিলাম। পরে এইসব অর্থহীন মনে হয়েছে। স্যার আমি কী বলছি আপনি কি শুনছেন?
হ্যাঁ শুনছি,
এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে আসল রহস্য পদার্থবিদ্যা বা অংকে না-আসল রহস্য মানুষের মনে। আকাশ যেমন অন্তহীন, মানুষের মনও তাই। পৃথিবীর বেশির ভাগ অংকবিদ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালবাসতেন। আমিও ভালবাসি। আকাশের দিকে তাকালে জাগতিক সব কিছু তুচ্ছ মনে হয়। we are so insignificant. আমাদের জন্ম-মৃত্যু সবই অর্থহীন!