হ্যাঁ আপনার ধারণা ঠিক। আমি মধু খাই না। এই ধারণা আপনার কেন হল এটা বুঝতে পারছি না। ব্যাখ্যা করবেন?
আমার সিক্সথ সেন্স এ রকম বলছিল।
সুলতান কঠিন গলায় বলল, সিক্সথ সেন্স বলে কিছু নেই। এটা আপনি যেমন জানেন, আমিও জানি। আমি মধু খাই না এটা কেন বললেন?
সুলতান তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে। তার হাতের মুঠি বন্ধ। প্রতিটি লক্ষণ বলে দিচ্ছে সে রেগে গেছে। রাগ সামলাতে পারছে না। মিসির আলি সুলতানের রাগটাকে তেমন গুরুত্ব দিলেন বলে মনে হল না। যেন তিনি ধরেই নিয়েছেন সুলতান রাগবে। মিসির আলি গাছের বেদিতে পা তুলে বসলেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন, সুলতান তোমার কাছে কি সিগারেট আছে? দিনের প্রথম চা-টা সিগারেট দিয়ে খেতে হয়। আমি আমার প্যাকেট তুলে উপরে রেখে এসেছি। সিগারেট হাতে নিয়ে বসে থাকি। এর মধ্যে চা চলে আসবে। সিগারেট হাতে বসে থাকার মধ্যেও আনন্দ আছে। যারা ধূমপান করে না তারা সুস্বাস্থের আনন্দ পায়, সিগারেট হাতে বসে থাকার আনন্দটা পায় না।
বরকত চা নিয়ে এসেছে। দুজনের জন্যেই চা এনেছে। সুন্দর কাপে করে মিসির আলির জন্যে চা আর তার নিজের জন্যে গ্লাস ভর্তি চা। মিসির আলি বললেন, বরকত তুমি কাপটা তোমার বড় সাহেবকে দাও। আর আমি তোমার গ্লাসে করে চা খাব। গ্লাস ভর্তি চা খাওয়ায় আলাদা আনন্দ আছে। কাপের চা বাইরে থেকে দেখা যায় না। গ্লাসের চা দেখা যায়।
সুলতান সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বলল, আমি মধু খাই না। এই ধারণার পেছনে আপনার ব্যাখ্যাটা এখন শুনি। আমি ব্যাখ্যাটা শোনার জন্যে অপেক্ষা করছি।
আমার ব্যাখ্যা খুবই সহজ। তুমি আমাকে মধু দেবার সময় নাক-মুখ কুঁচকে ফেলেছিলো। রিফ্লেক্স একশান। সেখান থেকেই বুঝলাম তুমি মধু খাও না। খেলেও যে মধুটা আমাকে খেতে দিয়েছ সেটা খাও না।
তাহলে শুধু শুধু সিক্সথ সেন্সের কথা কেন বললেন?
আমি একটা ছোট্ট পরীক্ষা করলাম। আমি দেখলাম সিক্সথ সেন্সের কথা শুনে তুমি চমকে গেলে, খানিকটা রেগেও গেলে। চমকাও কি না এটাই ছিল আমার পরীক্ষা। বরকত দেখি চা ভালো বানায়।
সুলতান তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে সে অপেক্ষা করছে মিসির আলি কী বলেন তা শোনার জন্যে। মিসির আলি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, তুমি যখন বললে সুন্দরবনে নানান ধরনের ফুলের মধু পাওয়া যায়—খলিসা ফুলের মধু, কেওড়া ফুলের মধু, গড়ান ফুলের মধু, তখন হঠাৎ করে আমার মনে হল-অনেক বিষাক্ত ফুলও তো প্রকৃতিতে আছে। যেমন ধৃতরা ফুল। এমন কি হতে পারে না যে কিছু মৌমাছি ধুতরা ফুল থেকে মধু নেয়। সেই সব ফুলে ধুতরার ভয়ঙ্কর বিষ মিশবে। সেই বিষ হল a very powerful haducinating drug যা মানুষের চিন্তায় কাজ করে। চেতনাকে পাল্টে দেয়। রিয়েলিটির ভুল ব্যাখ্যা করে। সুন্দরবন হল একটা ট্রপিক্যাল ফরেস্ট। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন। সেখানে ধুতরা ফুল থাকারই কথা। তুমি বল থাকবে না?
হ্যাঁ থাকবে। এবং আছে। সুন্দরবনের ভেতর মাঝে মাঝে হঠাৎ কিছু ফাঁকা জায়গা পাওয়া যায়। সেখানে প্রচুর ধুতরা ফুল ফোটে।
সেই ফুল থেকে মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে?
সব মৌমাছি করে না। বিশেষ এক ধরনের মৌমাছি করে। এদের মৌমাছিও বলে না। বলে মৌ পোকা।
মিসির আলি বললেন, যেকোনোভাবেই হোক বিশেষ ধরনের এই মধু তোমার সংগ্রহে আছে। তার খানিকটা তুমি আমাকে দুদফায় খাইয়েছ যে কারণে আমি ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখেছি। দুঃস্বপ্নের সঙ্গে বাস্তব মিশে ছিল। প্রথম রাতে সাপ নিয়ে কথা হল-আমি স্বপ্নে দেখলাম সাপ। দ্বিতীয় রাতে কুকুর নিয়ে কথা হল। লিলি আমাকে বলল দরজার ছিটিকিনি বন্ধ করে ঘুমুতে-মাঝে মাঝে কুকুর দোতলায় উঠে আসে। সেই রাতে আমি স্বপ্ন দেখলাম কুকুর। কুকুরটা ঘরে ঢুকে আমার বিছানার চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
সুলতান বলল, আপনার ডিডাকটিভ লজিক যে ভালো, আমি জানতাম। এতটা ভালো বুঝতে পারি নি। I am impressed.
মিসির আলি চায়ের গ্লাস নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, এখন তুমি কি আমাকে বলবে, কেন আমাকে এখানে এনেছি? তারা দেখানোর জন্যে নিশ্চয়ই আন নি। চিঠিতে তুমি টোপ ফেলার কথা বলেছ। সেটা কথার কথা ছিল না। আসলেই টোপ ফেলে এনেছি। কেন এনেছ? খোলাখুলি বলতে অসুবিধা আছে?
না অসুবিধা নেই। আপনার সঙ্গে অনেক লুকোচুরি খেলা হয়েছে। আর খেলার প্রয়োজন দেখছি না।
তাহলে তোমার উদ্দেশ্যটা বলে ফেল। তুমি কিছু মনে কোরো না-আমার এখানে থাকতে ভালো লাগছে না। আমি আজ চলে যাব। দুপুরের পর রওনা হতে চাই।
সুলতান বলল, আজ অমাবস্যা। আকাশে মেঘ নেই। আমি নিশ্চিত যে আজ রাতে আকাশ পরিষ্কার থাকবে। আপনাকে আজ রাতে একটা স্পাইরাল গ্যালাক্সি দেখাব। দেখার পর মনে হবে আপনার মানব জীবন ধন্য।
আমার গ্যালাক্সি দেখার শখ এখন নেই। আমি চলে যেতে চাচ্ছি। আকাশ দেখতে ইচ্ছা করছে না।
সুলতান শীতল গলায় বলল, স্যার শুনুন। আপনার ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা ভুলে যান। আমি আপনাকে এখান থেকে বের হতে দেব না।
মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, বের হতে দেবে না?
সুলতান বলল, না। এবং তার জন্যে কোনো সমস্যাও হবে না। কেউ জানবেও না আপনি কোথায় আছেন। আপনার পরিচিতজনারা জানে আপনার স্বভাব হচ্ছে মাঝে মধ্যে বাইরে কোথাও চলে যাওয়া। সবাই ভাববে। এবারো তাই হয়েছে। আপনার এক ছাত্র আপনার জন্য টেকনাফে অপেক্ষা করছে। সে যখন দেখবে আপনি এসে পৌঁছান নি তখন সে খানিকটা খোঁজ করবে। সবাই জানবে টেকনাফ যাবার পথে আপনি হারিয়ে গেছেন। কিছুদিন পর মানুষ আপনাকে ভুলে যাবে। মানুষ বিস্মৃতিপরায়ণ জীব।