কিছু বলবে না কেন?
বরকত চাপা গলায় বলল, একটা ঘটনা ঘটাইছি। আপনের জুতা আর কাপড় শুকাইয়া দিছি! অখন এরা আপনের শইল্যের গন্ধ চিনে।
মিসির আলি বললেন, কাজটা তুমি নিজ থেকে করে নি। কেউ তোমাকে করতে বলেছে। কে বলেছে?
বরকত জবাব দিল না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মিসির আলির মনে হল বরকত তার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। এখন আর কথা বলবে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকবে।
মিসির আলি বললেন, গেট খুলে দাও নদীর পাড়ে বেড়াতে যাব। এত কাছে নদী, অথচ নদীই দেখা হয় নি।
বরকত বলল, গেইট খুলন যাইব না। বড় সাবের নিষেধ আছে।
নিষেধ?
জি নিষেধ। আমি খুলতে চাইলেও খুলতে পারব না। চাবি থাকে বড় সাবের কাছে।
চাবি সব সময় বড় সাহেবের কাছে থাকে?
বরকত শীতল গলায় বলল, সব সময় চাবি উনার কাছে থাকে না। যখন আপনের মতো কেউ বেড়াইতে আসে তখন চাবি উনার কাছে থাকে।
মিসির আলি বললেন, যাতে অতিথিরা পালিয়ে যেতে না পারে সেই জন্যে?
কী জন্যে সেইটা আমি জানি না বড় সাহেব জানে।
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি নামাজ পড়তে যাও। তোমার নামাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। শেষে নামাজ কাজ হবে।
বরকত গম্ভীর মুখে বলল, ফজরের নামাজ দুপুর পর্যন্ত কাজা হয় না। এর একটা ইতিহাস আছে। ইতিহাসটা শুনবেন?
বল শুনি।
নবীয়ে করিম একবার দেরি কইরা ঘুম থাইকা উঠছিলেন। নবীয়ে করিমের জন্যে আমরা মাফ পাইছি।
এটা জানতাম না।
ভদ্ৰলোকরা সব বিষয় জানে, ধৰ্মকৰ্ম বিষয়ে জানে না। এইটা একটা আফসোস। আফসোস তো বটেই। বরকত তোমার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগল। আমি বাগানের দিকে যাচ্ছি তুমি নামাজ শেষ করে চা নিয়ে এসো। দুৰ্বকাপ চা আনবে। আমার জন্যে এক কাপ তোমার জন্যে এক কাপ। আমরা চা খেতে খেতে গল্প করব। ভালো কথা আমি যখন তোমাকে ডাকলাম তুমি এত ভয় পেলে কেন? ভয়ে হাত থেকে একেবারে বদনা পড়ে গেল।
বরকত জবাব দিল না, তার ঠোঁটের কোনায় অস্পষ্ট হাসির রেখা দেখা গেল। মিসির আলি হাঁটতে শুরু করলেন, চেৱী গাছের নিচে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর দৃষ্টি মাটির দিকে। হুইল চেয়ারের কোনো দাগ কি মাটিতে আছে? থাকার কোনোই কারণ নেই। কাল রাতে যা দেখেছেন তার পুরোটাই স্বপ্ন। এই সত্য সন্দেহাতীতভাবে সত্য। তারপরেও দেখা। মানুষের মন এমন যে একবার কোনো বিষয়ে সন্দেহ উপস্থিত হলে সেই সন্দেহ আর যেতেই চায় না। কাপড়ে ময়লা লেগে যাবার মতো। যত ভালো করেই ধোয়া হোক অস্পষ্ট দাগ থেকেই যায়। সেই দাগ বারবার ধুতে ইচ্ছা করে।
হুইল চেয়ারের পায়ের রেখা ভেজা মাটিতে আছে। মিসির আলির ভুরু কুঞ্চিত হল। স্বপ্নের একটি অংশ কি সত্যি? মানুষ যেমন মিথ্যা কথা বলার সময় মিথ্যার সঙ্গে কিছু সত্য মিশিয়ে দেয়, স্বপ্নেও কি সে রকম কিছু ঘটেঃ মস্তিষ্ক স্বপ্নের সঙ্গে সামান্য বাস্তব মিশায়। মিসির আলি হুইল চেয়ারের দাগ ধরে এগুতে লাগলেন। তাঁকে বেশিদূর যেতে হল না, তার আগেই থমকে দাঁড়াতে হল। লাইব্রেরি ঘরের বারান্দা থেকে সুলতান বলল, স্যার কী করছেন? সুলতানের গলায় চাপা কৌতূহল।
মিসির আলি বললেন, কিছু করছি না। হাঁটছি, প্রাতঃভ্রমণ বলতে পার।
আমার কাছে মনে হচ্ছে মাটিতে কী যেন খুঁজতে খুঁজতে এগুচ্ছেন। কী খুঁজছেন? হইল চেয়ারের পায়ের দাগ?
মিসির আলি বললেন, হ্যাঁ। তুমি কাল রাতে হুইল চেয়ার নিয়ে বাগানে ঘুরেছ। কোথায় কোথায় গিয়েছিলে তাই দেখছিলাম।
এই অনুসন্ধানের আপনার বিশেষ কোনো কারণ আছে কি?
না তেমন কোনো কারণ নেই।
শেষ রাতের দিকে বৃষ্টি থামল। আকাশ পরিষ্কার হল। আমি বাগানে ঘুরছিলাম, এবং আকাশ দেখছিলাম।
সুলতান হুইল চেয়ার নিয়ে লাইব্রেরি ঘরের বারান্দা থেকে নিচে নামতে শুরু করল। হুইল চেয়ারে বারান্দা থেকে বাগানে নামার জন্যে ব্যবস্থা করা আছে। তার পরেও তাকে নামতে হচ্ছে সাবধানে। সুলতান সহজ গলায় বলল, পঙ্গু মানুষেরও মাঝে মাঝে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছা করে। বাগানে যেতে ইচ্ছা করে। শীতের সময় বাগানে ঘুরে বেড়ানো সহজ। বর্ষার সময় বেশ কঠিন। কাদায় চাকা ড়েবে যায়। তখন পেছন থেকে কাউকে ঠেলতে হয়। স্যার আপনার রাতের ঘুম ভালো হয়েছিল?
হ্যাঁ ভালো হয়েছে।
বেশ ভালো, নাকি মোটামুটি ভালো?
বেশ ভালো ।
আপনি কি আর্লি রাইজার?
না। আজ কীভাবে কীভাবে যেন ঘুম ভেঙে গেছে। আমার কপালে সূর্যোদয় দৃশ্য নেই। শুধুই সূর্যাস্তের দৃশ্য।
সুলতান হালকা গলায় বলল, আমার কপালে সূর্যোদয় দৃশ্য প্রচুর পরিমাণে আছে। আমি রাতে ঘুমাই না। সকালে সূৰ্য দেখে ঘুমাতে যাই। আমার কপালে সূর্যাস্ত নেই।
মিসির আলি বললেন, আমি তোমাকে ঘুম থেকে বঞ্চিত করছি, যাও শুয়ে পড়।
সুলতান বলল, না, আজ আমি আপনার সঙ্গে গল্প করব। চলুন নীল মরিচ ফুল গাছটার কাছে। যাই। আপনি বেদিতে বসবেন! আমি বসব হুইল চেয়ারে। আমাদের আই লেভেল ঠিক থাকবে।
মিসির আলি বললেন, বরকতকে চা নিয়ে আসতে বলেছিলাম। তুমি চা খাবে?
খেতে পারি।
চায়ে চিনি কতটুক খাও?
কেন জানতে চান বলুন তো?
বিশেষ কোনো কারণ নেই। এমনি জিজ্ঞেস করলাম ।
দুচাম।
আমার ধারণা ছিল তুমি চায়ে চিনি খাও না।
এ রকম ধারণা হবার কারণ কী?
মধু খাও না তো তাই ভাবলাম মিষ্টি জাতীয় কিছুই খাও না।
সুলতান শীতল গলায় বলল, মধু খাই না আপনাকে কে বলল?
মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, কেউ বলে নি। আমার ধারণা তুমি খাও না। অন্যদের আগ্রহ করে খাওয়াও । আমার ধারণাটা কি ঠিক?