দরজায় শব্দ হল। টিকটক করে মোর্সকোডের মতো শব্দ করছে। যেন কেউ কোনো সংকেত দিচ্ছে। মিসির আলি দরজার দিকে তাকালেন। খোলা দরজার ওপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তবে কেউ যে আছে তা বোঝা যাচ্ছে। যে আছে তাকে মিসির আলি চেনেন না। কিন্তু কুকুরটা চেনে। সে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কুকুরটা সিঁড়ি বেয়ে নামছে। তার নেমে যাবার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
মিসির আলি দ্রুত বিছানা থেকে নামলেন। দরজা বন্ধ করে ছিটিকিনি টেনে দিলেন। টেবিলের কাছে এসে ঘড়ি দেখলেন। রাত তিনটা পঁচিশ। তিনি পরপর দুঃগ্লাস পানি খেলেন। তারপরেও তৃষ্ণ কমছে না। তিনি খুব যে নিশ্চিন্ত বোধ করছেন তাও না। স্বপ্নে যে কোনো সময় যে কোনো কিছু ঘটতে পারে। স্বপ্ন ফিজিক্সের সূত্র মেনে চলে না। হয়তো এক্ষুনি দেখা যাবে কুকুরটা বন্ধ দরজা ভেদ করে চলে এসেছে। সে একা আসে নি, সঙ্গী দুজনকেও নিয়ে এসেছে। মানুষের মতো কথা বলাও শুরু করতে পারে। না তা করবে না। স্বপ্ন ফিজিক্সের সূত্র না মানলেও সাধারণ কিছু নিয়ম মানে। আট ন বছরের বাচ্চা যদি কুকুর স্বপ্ন দেখে তাহলে সেই কুকুর তার সঙ্গে কথা বললেও বলতে পারে। মিসির আলি যে কুকুর দেখবেন সে কুকুর কথা বলবে না।
তিনি কী করবেন বুঝতে পারছেন না। বিছানায় উঠে আবার ঘুমিয়ে পড়ার ব্যবস্থা করবেন? নাকি হাটহাঁট করবেন? মিসির আলি জানালার কাছে চলে গেলেন। যদি কুকুরটাকে দেখা যায়। চেরী গাছের নিচে কেউ কি আছে? হ্যাঁ আছে তো বটেই। ঐ তো হুইল চেয়ারটা দেখা যাচ্ছে। হুইল চেয়ারের পেছনে আছে। বরকত। রাত তিনটা পঁচিশ মিনিটে ওরা দুজন কী করছে? তারা দেখার প্রস্তুতি?
হঠাৎ মিসির আলির বুকে একটা ধাক্কার মতো লাগল। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন হুইল চেয়ারে বসা মানুষটা উঠে দাঁড়িয়েছে। এই তো হাঁটতে শুরু করেছে। মন্দিরের দিকে কি যাচ্ছে? হ্যাঁ ঐ দিকে যাচ্ছে। এখন সিগারেট ধরিয়েছে! আবার ফিরে আসছে। হাতের জ্বলন্ত সিগারেট এখন ফেলে দিল। এই মানুষটা যে সুলতান তাতে কি কোনো সন্দেহ আছে? না কোনো সন্দেহ নেই। মানুষটা আবার হাঁটতে শুরু করেছে। মিসির আলি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন। না মানুষটা মন্দিরের দিকে যাচ্ছে না। সে মন্দিরের পেছনে যাচ্ছে। মন্দিরের পেছনে আছে কুয়া। এখান থেকে কুয়া দেখা সম্ভব না। কিন্তু স্বপ্নে সম্ভব। মিসির আলি কুয়া দেখার জন্যে অপেক্ষা করছেন। কুয়া দেখা গেল না। মানুষটা চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত মিসির আলি তাকিয়ে রইলেন।
মিসির আলির মাথায় সমুদ্ৰ গৰ্জনের মতো শব্দ হচ্ছে। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ। মনে হচ্ছে কাছেই কোথাও সমুদ্র আছে। বড় বড় ঢেউ উঠছে। ঢেউয়ের মাথায় সমুদ্র ফেনা। মাথা এলোমেলো লাগছে। কেউ কি ভরাট গলায় কবিতা আবৃত্তি করছে?
I let myself in at the kitchen door.
It is you, she said, I cant get up. Forgive me.
Not answering your knock. I can no more
Let people in than I can keep them out.
এটা কার কবিতা? মিসির আলি কিছুতেই মনে করতেন পারলেন না। ঘুমে তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তিনি বিছানায় শুয়ে পড়লেন। মাথার ভেতর কবিতাটা ভাঙা রেকর্ডের গানের মতো বেজে যাচ্ছে–
I let myself in at the kitchen door.
It is you, she said, I cant get up. Forgive me.
আমাকে ক্ষমা কর, আমি উঠতে পারছি না। আমাকে ক্ষমা কর, আমি উঠতে পারছি না। I can’t get up. Forgive me.
সূর্য ওঠার আগে
সূর্য ওঠার আগেই মিসির আলির ঘুম ভাঙল। অন্ধকার মাত্র কাটতে শুরু করেছে। টেবিলে রাখা হারিকেন নিভে গেছে। টেবিল ল্যাম্প দপদপ করছে। যেকোনো মুহূর্তেই নিভবে। মনে হচ্ছে হিসাব করে তেল দেওয়া। সূর্যের আলো ফুটবে আর এরা নিভে যাবে। মিসির আলি প্রথমেই তাকালেন দরজার দিকে-ছিটিকিনি লাগানো আছে, দরজা বন্ধ। তিনি বিছানায় উঠে বসে মেঝের দিকে তাকালেন–মেঝে ঝকঝক করছে। ঝড়বৃষ্টির রাতে কোনো কুকুর উঠে এলে মেঝেতে তার পায়ের দাগ থাকত। মেঝেতে কোনো দাগ নেই। গত রাতে মোটামুটি ভয়াবহ একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কারণ নেই, তবু সন্দেহটা যাচ্ছে না।
তিনি বিছানা থেকে নামলেন। দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। সকালের প্রথম আলোয় নদী দেখা যাচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল নদীটি পাচিল ঘেরা বাড়ির সঙ্গে যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ওই বাড়িটার সঙ্গে নদীর কোনো যোগ নেই। নদী দেখতে ভালো লাগছে না।
ভেতরের উঠোনে একটা জলচৌকির উপর বরকত দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে পেতলের বদনা। সে মিসির আলিকে দেখতে পায় নি। মিসির আলি ডাকলেন, এই বরকত। বরকত ভয়াবহভাবে চমকে উঠল। হাত থেকে বদনা জলচৌকিতে পড়ে ঝন ঝন শব্দ হল। এতটা চমকানোর কোনো কারণ নেই। মিসির আলি বললেন, কী করছ?
নামাজের অজু করি। ফজরের নামাজ।
মিসির আলি বিস্মিত হলেন। এত দীর্ঘ বাক্য বরকত তার সঙ্গে এর আগে ব্যবহার করে নি।
তোমার কুকুর কি বাধা আছে?
জি বান্দা। আসেন নিচে আসেন।
মিসির আলি নিচে নেমে এলেন। বরকত বলল, চা খাইবেন?
মিসির আলি বললেন, গরম চা খেতে পারলে ভালো হত।
নামাজ শেষ কইরা চা দিতাছি।
তোমার কুকুরগুলি কোথায় একটু দেখি।
বরকত আঙুল উঁচিয়ে পেয়ারা গাছের সঙ্গে বাধা কুকুরগুলি দেখাল। গলা নামিয়ে বলল, কাছে যান। শইলে হাত দেন। আপনেরে কিছু বলব না।