পুন্নাগ ফুলের কথা লেখা আছে। খুব আগ্রহ করে লেখা। এই ফুল বেটে গায়ে মাখলে গায়ের রঙ উজ্জ্বল হয় বলে তিনি লিখেছেন। এর থেকে ধারণা করা যায় যে গায়ের রঙ নিয়ে তিনি খুব চিন্তিত ছিলেন। আমার ধারণা তাঁর মেয়েগুলির গায়ের রঙ ছিল কালো। তিনি মন্দিরে কালী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন যে কালী হল গৌর কালী অর্থাৎ সেই কালীর গায়ের রঙও সাদা। তার মানে গায়ের রঙের প্রতি অশ্বিনী বাবুর মনে অবসেসন তৈরি হয়েছিল।
লিলি মুগ্ধ গলায় বলল, বাহ। আপনি তো চট করে একটা ব্যাপার ধরে ফেলেছেন!
মিসির আলি বললেন, আমি একটা হাইপোথিসিস দাড় করিয়েছি। হাইপোথিসিসটা সত্যি কি না তার এখনো প্রমাণ হয় নি।
লিলি একটু ঝুঁকে এসে গলা নামিয়ে বলল, আচ্ছা চাচাজী মাঝে মাঝে কিছু বাড়ি যে অভিশপ্ত হয়ে যায় এটা কি আপনি জানেন?
মিসির আলি সোজা হয়ে বসতে বসতে বললেন, অভিশপ্ত বাড়ি বলে কিছু নেই। বাড়ি হল বাড়ি, ইট পাথরের একটা স্ট্রাকচার। এর বেশি কিছু না।
লিলি বলল, চাচাজী আমার কথা শুনুন, এমন অনেক বাড়ি আছে যেখানে বিশেষ কিছু ঘটনা বার বার ঘটতে থাকে। একটা চক্রের মতো ব্যাপার। চক্র ঘুরতে থাকে। এই বাড়িটাও সে রকম একটা বাড়ি।
তার মানে?
এই বাড়িটাও একটা চক্রের মধ্যে পড়ে গেছে। আপনি এমন বুদ্ধিমান একজন মানুষ… আপনার চোখে চক্রটা পড়ছে না কেন?
মিসির আলি বললেন, চক্র বলে কিছু নেই লিলি।
লিলি চাপা গলায় বলল, চক্র অবশ্যই আছে। অশ্বিনী বাবু তাঁর বাড়িতে গৌর কালী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুলতানও কি তাই করে নিঃ মন্দিরে সে কি একটি মূর্তি রাখে নিঃ চাচাজী আমার ভালো লাগছে না। আমি যাচ্ছি। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। আজ রাতে বৃষ্টি থামবে না। সারারাত বৃষ্টি হবে। কালও বৃষ্টি হবে। বিছানা থেকে নেমে ছিটিকিনি লাগান। শেষে দেখা যাবে ছিটিকিনি না লাগিয়েই আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। এ বাড়িতে কখনো ছিটিকিনি না লাগিয়ে ঘুমুবেন না। কখনো না।
মিসির আলি বিছানা থেকে নামলেন, দরজার ছিটিকিনি লাগালেন। বিছানায় এসে বসলেন। অশ্বিনী বাবুর ডায়েরি এখন আর তাঁর পড়তে ইচ্ছা করছে না। বৃষ্টির বেগ আরো বাড়ছে। গাছের পাতায় শো শো শব্দ হচ্ছে। মিসির আলি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। তাঁর খুবই অস্থির লাগছে। চক্রের ব্যাপারটা মাথা থেকে দূর করতে পারছেন না। বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডে চক্ৰ তো আছেই। পৃথিবী ঘুরছে সূর্যের চারদিকে। প্রতিবারই একই জায়গায় ঘুরে ঘুরে আসছে। ঘুরছে গ্যালাক্সি। অতি ক্ষুদ্র যে ইলেকট্রন সেও ঘুরপাক খাচ্ছে নিউক্লিয়াসের চারদিকে। পদার্থের সর্বশেষ অবস্থা ল্যাপটনস-এর ভর নেই, চার্জ নেই–অস্তিত্বই নেই, শুধু আছে ঘূর্ণন। স্পিন। জনের পর মৃত্যু-জীবন চক্র। বিগ ব্যাং-এ মহাবিশ্ব তৈরি হল। মহাবিশ্ব ছড়িয়ে পড়ছে। কোনো এক সময় আবার তা সংকুচিত হতে শুরু করবে। আবার এক বিন্দুতে মিলিত হবে। আবার বিগ ব্যাং—আবারো মহাবিশ্ব ছড়াবে–The expanding Universe …
মিসির আলি কখন ঘুমিয়ে পড়লেন নিজেই জানেন না।
তার ঘুম ভাঙল নিশ্বাসের শব্দে। কে যেন তাঁর গায়ে গরম নিশ্বাস ফেলছে! খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার। ঘরের দরজা বন্ধ। বাইরের কারো ঢ়োকার কোনো পথ নেই। মিসির আলি চোখ মেললেন-হারিকেনের আলোয় স্পষ্ট দেখলেন বিশাল একটা কুকুর। কুকুরটার মুখ তাঁর মাথার কাছে, তার গরম নিশ্বাস চোখেমুখে এসে লাগছে। পশুদের চোখ অন্ধকারে সবুজ দেখায়। এর চোখও সবুজ। এ তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। মিসির আলি চোখ বন্ধ করে ফেললেন। ব্যাপারটা স্বপ্ন তো বটেই। অত্যন্ত জটিল স্বপ্ন যা মস্তিষ্কের অতল গহবর থেকে উঠে এসেছে।
কুকুরটা চাপা শব্দ করছে। এই শব্দও স্বপ্নের অংশ। কুকুরটা এখন খাট থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই তো এখন ফিরে আসছে। আবার যাচ্ছে। এখন সে খাটের চারদিকে পাক খেতে শুরু করেছে। কুকুরটা ঘুরছে চক্রাকারে। আবারো সেই চক্র চলে এল। চক্রের হাত থেকে মানুষের মুক্তি নেই। মিসির আলি চোখ মেললেন। অতি সাবধানে মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন দরজার দিকে। দরজা খোলা। খোলা দরজা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। বাতাসও হচ্ছে না।
দরজা খুলল কীভাবে? বাইরে থেকে দরজা খোলার কোনো ব্যবস্থা কি আছে? এটা নিয়ে চিন্তা করার কোনো অর্থ আছে? কোনোই অর্থ নেই। স্বপ্নে বন্ধ দরজা, খোলা দরজা বলে কিছু নেই। স্বপ্নের লজিক খুঁজতে যাওয়া অর্থহীন। রাত কত হয়েছে? টেবিলের উপর হাতঘড়িটা রাখা আছে। ঘড়ি দেখতে হলে তাঁকে উঠে বসতে হবে। তাতে শব্দ হবে। কুকুরের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে। এই কাজটা এখন কিছুতেই করা যাবে না। ভয়ঙ্কর এলশেশিয়ান কুকুর। তার মনে কোনো রকম সন্দেহ উপস্থিত হলেই সে ঝাপ দিয়ে পড়বে। মিসির আলির হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল। খুব পানির তৃষ্ণ হচ্ছে। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে।
এই তৃষ্ণবোধ মিথ্যা। কারণ পুরো ব্যাপারটাই মিথ্যা। তিনি স্বপ্ন দেখছেন। এর বেশি কিছু না। কুকুরটা যদি তার উপর ঝাঁপ দিয়েও পড়ে তাতে তাঁর কিছু হবে না। বরং লাভ হবে—দুঃস্বপ্ন ভেঙে যাবে। তিনি মিথ্যামিথ্যি জাগবেন না। সত্যিকার অর্থেই জাগবেন। তখনো যদি তৃষ্ণা থাকে তাহলে পানি খাবেন। তৃষ্ণা না থাকলে চা খাবেন। চা খাবার পর একটা সিগারেট।
মিসির আলি খুব সাবধানে বিছানায় উঠে বসলেন। কুকুরটা হাঁটা বন্ধ করে স্থির হয়ে গেল। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার লেজ নড়ছে। এর মানে কি এই যে সে বাঁপ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে? মিসির আলি এখন মনেপ্ৰাণে চাচ্ছেন কুকুরটা তার উপর ঝাপ দিয়ে পড়ুক। স্বপ্ন ভেঙে যাক। কুকুর ঝাপ দিচ্ছে না। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আচ্ছা অশ্বিনী বাবুর কি কুকুর ছিল? জিজ্ঞেস করে জানতে হবে।