পুন্নাগ প্রসঙ্গে আরো কোনো কৌতুহলোদ্দীপক তথ্য পাইলে লিপিবদ্ধ করা হইবে।
এই পর্যন্ত লেখার পর দুটি পাতা খালি। কিছুই লেখা নেই। তৃতীয় পাতায় দিনক্ষণ দিয়ে তারা দর্শনের বর্ণনা।
অদ্য ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ইংরেজি ২০শে মে মধ্যরজনী।
বিভূতিবাবুর হিসাব অনুযায়ী অদ্য রজনী দশ ঘটিকায় সারমেয় যুগল মধ্যগগনে অবস্থান করিবে ; সারমেয় যুগল দর্শনের সমস্ত ব্যবস্থা সুসম্পন্ন করিয়াছি। কন্যাদের মাতাকে এই অপূর্ব দৃশ্য দেখিবার জন্যে বলিয়াছিলাম। তিনি শিরঃপীড়ায় আক্রান্ত বলিয়া অপারগতা প্ৰদৰ্শন করিলেন। কিঞ্চিৎ ব্যথিত হইয়াছি। জগতের কোনো মনোমুগ্ধকর দৃশ্য একা উপভোগ করা যায় না।
আকাশ পরিষ্কার আছে। সন্ধ্যাকালে মেঘ ছিল—এখন মেঘ দূরীভূত হইয়াছে। ঈশ্বরের অসীম কৃপা।
বিভূতিবাবুর পত্রানুযায়ী সারমেয় যুগলের একটির গলায় এই মণ্ডলের সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল তারকাটি অবস্থিত। এই তারকাটির প্রভা তৃতীয় মাত্রার। তারকাটির নাম চার্লসের হৃদয়। সম্রাট প্রথম চার্লসের স্মৃতির উদ্দেশে এই নামকরণ।
সারমেয় যুগলের উল্লেখ বেদে আছে। ইহাদের বলা হইয়াছে যমের দুয়ারের প্রহরী। এই মণ্ডলের দুইটি উজ্জ্বল তারকার একটির ভারতীয় নাম জ্যেষ্ঠ কালকত্বজ্ঞ আরেকটির নাম কনিষ্ঠ কালকন্দ্র। জ্যেষ্ঠ কলকজ্ঞ একটি বিষম তারা এবং অত্যন্ত সৌন্দর্যমণ্ডিত। যে চারটি তারা দিয়া কন্যার হীরক নামক বিখ্যাত চিত্রটি গঠিত জ্যেষ্ঠ কলকজ্ঞ তার একটি।
আজ সারমেয় যুগল দেখিবার সৌভাগ্য যেন হয় তার জন্যে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করিয়াছি।
মিসির আলি দ্রুত পাতা উল্টালেন। ডায়েরিতে বিচিত্র সব বিষয়ে লেখা আছে। জ্যামিতিক চিহ্ন আছে। তার ব্যাখ্যা আছে। জায়গায় জায়গায় টকা-টিপ্লনি আছে।
যেমন জ্ঞান সম্পর্কে বলা হয়েছে—
জ্ঞান
জ্ঞান দুই প্রকার। পবিত্র জ্ঞান এবং অপবিত্র জ্ঞান। অপবিত্র জ্ঞান ঈশ্বর কর্তৃক অনুমোদিত। আদি মানব আদমের পতন হইয়াছিল ঈশ্বর কর্তৃক অনুমোদিত জ্ঞান আহরণের জন্যে। অনুমোদিত জ্ঞান অতীব রহস্যময় জ্ঞান। যদিও পরিত্যাগ লাভের জন্যে এই জ্ঞানের প্রয়োজন নাই।
পুন্নাগ ফুলের কথা কয়েক পাতা পরেই আবার পাওয়া গেল।
পুন্নাগ
সৌরভ্যং ভুবন এয়েহপি বিদিতং পুষ্পেষু লোকোত্তরং
কীৰ্ত্তিঃ কিঞ্চ দিগঙ্গনাঙ্গনগতা কিন্ত্বতদেকংশৃনু।
সর্বান্যেবা গুণানি যানিগিরতি পুন্নাগে তে সুন্দরান্
উজঝণ্ডি খলু কোটরেষু গরল জ্বালানদ্বিজিহ্বালী।
অর্থ : হে পুন্নাগ, তোমার সুগন্ধ ত্রিভুবন খ্যাত। তোমার যশ ও খ্যাতি দিগাঙ্গনারা নিজ অঙ্গনে ছাড়াইয়া রাখে। তবু তোমার একটি অখ্যাতি। তোমার শরীরের কোটরে বাস করে বিষধর সর্প।
নোট: পুন্নাগ বৃক্ষের কোটরে বিষধর সর্প বাস করে এই তথ্য জানা ছিল না। হায় এই বিপুল বসুধার কত অল্পই না। আমি জানি!
দরজায় খটখটি শব্দ হচ্ছে। বই নামিয়ে মিসির আলি বললেন, কে?
চাচাজী আমি লিলি। আপনার কিছু লাগবে?
না। আমার কিছু লাগবে না।
আপনার ঘরের ছিটিকিনি বরকতকে ঠিক করতে বলেছিলাম। বরকত কি ঠিক GKER?
ইয়া ঠিক করেছে।
ছিটিকিনি লাগিয়েছেন?
না।
ছিটিকিনি লাগিয়ে ঘুমুবেন। ভুলবেন না যেন। কুকুরগুলি মাঝে মাঝে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠে। এই জন্যে বলছি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যদি দেখেন আপনার মাথার কাছে এলশেশিয়ান তাহলে ভয়েই হার্টফেল করবেন।
অবশ্যই ছিটিকিনি লাগিয়ে ঘুমাব। তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছি কেন? ভেতরে এস।
আপনি আসতে বলছেন না, এই জন্যে আসতে পারছি না। আমি আপনার জন্যে পান নিয়ে এসেছি।
এস ভেতরে এস।
লিলি পানের বাটা হাতে ঘরে ঢুকল। হাসিমুখে বলল, আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছে দূরবীনওয়ালা। আমার দায়িত্ব হল আপনাকে জাগিয়ে রাখা।
কেন কল তো?
দূরবীনওয়ালার ধারণা হয়েছে কিছুক্ষণ বৃষ্টি হবার পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে, তখন তারা দেখা যাবে। বৃষ্টির পর আকাশ নাকি ঝকঝকে হয়ে যায়। তখনই তারা দেখার আসল মজা।
ও আচ্ছা।
আপনি একবার ঘুমিয়ে পড়লে তো আর আপনাকে জাগানো ঠিক হবে না। তাই আপনাকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা। এখন বলুন কী করলে আপনি জেগে থাকবেন?
জেগে থাকা আমার জন্যে কোনো সমস্যা না। আমি অনেক রাত জাগি। তুমি আমাকে জেগে থাকতে বলেছি। আমি জেগে থাকব।
অশ্বিনী বাবুর ডায়েরি পড়ছেন?
হুঁ।
মরা মানুষের ডায়েরি পড়ে লাভ কী বলুন তো? মানুষটা তো মরেই গেছে। এরচেয়ে জীবিত মানুষের ডায়েরি পড়া ভালো। আপনি এত আগ্রহ করে পুরোনো ডায়েরি পড়েন জানলে আমি ডায়েরি লেখার অভ্যাস করতাম। চাচাজী নিন পান খান।
মিসির আলি পান হাতে নিলেন। লিলি চেয়ার টেনে খাটের পাশে বসেছে। তাকে ক্লান্ত লাগছে। পরপর দুবার হাই তুলল। মিসির আলি বললেন, তোমার ঘুম পাচ্ছে তুমি ঘুমিয়ে পড়। সুলতানকে বলে রেখো বৃষ্টি কমলে যেন আমাকে খবর দেয়। আমি জেগে থাকব।
আমার সঙ্গে গল্প করতে আপনার ভালো লাগছে না। তাই না? আপনার মন পড়ে আছে অশ্বিনী বাবুর লেখাতে। ঠিক বলছি না চাচাজী?
মিসির আলি বললেন, ডায়েরিটা পড়ে শেষ করতে ইচ্ছা হচ্ছে এটা ঠিক। তার মানে এই না যে তোমার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে না। তুমি খুব গুছিয়ে কথা বল।
লিলি বলল, অশ্বিনী বাবুর ডায়েরি পড়ে কী তথ্য বের করলেন বলুন শুনি।
মাত্র তো পড়া শুরু করেছি।
যা পড়েছেন সেখান থেকে এখনো ইন্টারেস্টিং কিছু বের করতে পারেন নি?