মেয়েটার সত্যি কি ক্ষমতা আছে?
মেয়েটার শুধু যে ক্ষমতা আছে তা না, ভয়াবহ ক্ষমতা আছে।
তুমি নিজে দেখেছ?
হ্যাঁ। আপনি তাকে দেখে খুবই অবাক হবেন! প্রথমে আপনার বিশ্বাস হবে না। ভাববেন ঠাট্টা করা হচ্ছে।
মিসির আলি বললেন, তুমিই কি সেই মেয়ে?
লিলি হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে খিলখিল করে হেসে ফেলল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, চাচাজী শুনুন মধু আপনাকে খেতেই হবে। ইচ্ছা না করলেও খেতে হবে। দূরবীনওয়ালা যদি শোনে আপনাকে মধু দেওয়া হয় নি তাহলে খুব রাগ করবে। আমাকে বলা হয়েছে আজ যেন কেওড়া ফুলের মধু দেওয়া হয়।
মধু না খেলে সুলতান রাগ করবে?
রাগের চেয়েও যেটা করবে তা হল মেজাজ খারাপ।
মিসির আলি বললেন, নিয়ে এস তোমার মধু।
লিলি বলল, সুন্দরবনের বানররা মধু কীভাবে খায় এই গল্প কি আপনি জানেন?
না জানি না!
আপনি আঙুলে মধু মাখিয়ে খেতে শুরু করুন। আমি গল্পটা করি। ছোট বাচ্চাদের যেমন গল্প বলে বলে খাবার খাওয়াতে হয় আপনাকেও সে রকম গল্প বলে বলে মধু খাওয়াক।
ঠিক আছে, শুরু কর তোমার গল্প।
কোনো বানরের যখন মধু খেতে ইচ্ছা করে সে তখন নদীর পাড়ে চলে যায়। সারা গায়ে কাদা মাখে। তারপর রোদে বসে এই কাদা শুকায়। আবার যায় কাদায়। আবারো কাদায় হুটোপুটি করে গায়ে কাদা মাখে। আবারো রোদে শুকায়। এই প্রক্রিয়াটি কয়েকবার করার পর বানরের গায়ে শক্ত কাদার একটা স্তর পড়ে যায়। তখন সে মহানন্দে চাক ভেঙে মধু খায়। মৌমাছিরা কাদার স্তরের জন্যে তার গায়ে হুল ফুটাতে পারে না। বুলেট প্রাফ জ্যাকেটের মতো মৌমাছি ধ্রুফ কর্দম জামা। চাচাজী ঘটনাটা কি আপনার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগছে?
হ্যাঁ ইন্টারেস্টিং তো বটেই।
সুন্দরবনের মধু নিয়ে আমি এর চেয়েও এক শ গুণ ইন্টারেস্ট্রিং একটা গল্প জানি। সেটা আজ বলব না। অন্য একদিন বলব।
সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি
সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টি যে মুষলধারে পড়ছে তা না, তবে বাতাস প্রবল বেগে বইছে। বাড়ির চারদিকে প্রচুর গাছপালা বলে ঝড়ের মতো শব্দ হচ্ছে। এমন ঝড়বৃষ্টির রাতে আকাশ দেখার প্রশ্নই আসে না। মিসির আলি দোতলায় তাঁর ঘরে আধশোয়া হয়ে আছেন। কিছুক্ষণ আগেই রাতের খাবারের পর্ব শেষ করে এসেছেন। বিছানা থেকে আর নামতে হবে না। এটা ভেবেই শান্তি শান্তি লাগছে। ঝড়বৃষ্টি শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই আবহাওয়া শীতল হয়েছে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। যতই সময় যাচ্ছে ততই ঠাণ্ডা বাড়ছে। মিসির আলি তার গায়ে পাতলা চাঁদ র দিয়েছেন। কোলবালিশ আড়াআড়ি রেখে তার উপর পা তুলে দিয়েছেন। মোটামুটি আরামদায়ক অবস্থান। তাঁর মাথার কাছে টেবিলের উপর একটা হারিকেন এবং কেরোসিনের টেবিল ল্যাম্প। তাতেও ঘরে তেমন আলো হচ্ছে না। মিসির আলির হাতে অশ্বিনী কুমার বাবুর হাতে লেখা ডায়েরি। লেখা খুব স্পষ্ট নয় এবং যথেষ্ট পরিমাণে প্যাচানো। এই আলোয় পড়তে কষ্ট হচ্ছে তারপরেও স্বস্তির কারণ আছে–হঠাৎ ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে ঘর অন্ধকার হবে না। ঢাকা শহরে ঝড়বৃষ্টি মানেই টেনশন-এই বুঝি ইলেকট্রসিটি চলে গেল!
বরকত এসে টেবিলে চায়ের ফ্লাস্ক এবং কাপ রেখে গেছে। দরজার ছিটিকিনি ঠিক করে দিয়ে গেছে। মিসির আলি বরকতের সঙ্গে টুকটাক আলাপ চালাবার চেষ্টা করেছিলেন। লাভ হয় নি। মিসির আলির ধারণা কোনো এক বিচিত্র কারণে বরকত তাকে পছন্দ করছে না।
ভালো দুৰ্যোগ শুরু হয়েছে। মিসির আলি গাছের ডাল ভাঙার শব্দ শুনলেন। ঝড়বৃষ্টির সময় গাছের পাখিরা কোনো ডাকাডাকি করে না। তারা একেবারেই চুপ হয়ে যায়। অথচ তাদেরই সবচেয়ে বেশি ডাকাডাকি করার কথা। কুকুররা মনে হয় প্রাকৃতিক দুৰ্যোগ পছন্দ করে না। মাঝে মাঝেই তাদের ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা যাচ্ছে। তারা কেউ আলাদা আলাদা ডাকছে না, যখন ডাকছে তিনজন এক সঙ্গেই ডাকছে।
মিসির আলি খুব মন দিয়েই ডায়েরি পড়ার চেষ্টা করছেন। শুধু কুকুররা যখন ডেকে উঠছে তখন মনোসংযোগ কেটে যাচ্ছে। কেন জানি কুকুরের ডাকটা শুনতে ভালো লাগছে না।
অশ্বিনী কুমারের ডায়েরিটি ঠিক ডায়েরির আকারে লেখা না। অনেক অপ্রয়োজনীয় জিনিস লেখা আছে। কিছু কিছু লেখাতে দিনক্ষণ স্থানকাল উল্লেখ করা। বেশির ভাগ লেখাতেই তারিখ নেই। বাজারের হিসাব আছে। চিঠির খসড়া আছে। আয়ুৰ্বেদ অষুধের বর্ণনা আছে। ডায়েরির শুরুই হয়েছে আয়ুৰ্বেদ অষুধের বর্ণনায়।
গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল এবং গৌর করিবার অব্যৰ্থ উপায়।
পুন্নাগের কচি ফল দিয়া ক্বাথ প্রস্তুত করিতে হইবে। উক্ত ক্বাথ জ্বাল দিয়া ভাসমান তৈল পাওয়া যাইবে। উক্ত তৈল সর্বাঙ্গে মাখিতে হয়। পুন্নাগের আরেক নাম রাজচম্পক।
রামায়ণ মহাকাব্যে পুন্নাগের সুন্দর বর্ণনা আছে। রাবণ সীতাকে হরণ করিবার পরের অংশে আছে, রাম ভ্রাতা লক্ষণকে নিয়া বিষন্ন মনে হাঁটিতেছিলেন। হঠাৎ চোখে পড়িল পুন্নাগ পুষ্পের মেলা–
তিল্লকাশোক পুন্নাগ বকুলোদ্দাল কামিনীম্
রম্যোপবন সম্বাধীং পদ্মসম্পীড়িতো কাম।।
নোট : আমি পুন্নাগ তৈল প্ৰস্তৃত করিবার চেষ্টা করিয়াছি। ক্বাথ জ্বাল দিলে তৈল প্ৰস্তুত হয় না। নিশ্চয়ই অন্য কোনো প্রক্রিয়া আছে।
বৈদ্যদের নথিতে গাত্ৰবৰ্ণ ঔজ্জ্বল্যের নিমিত্ত রক্তচন্দন, অনন্তমূল এবং মঞ্জিষ্ঠার উল্লেখ আছে। তবে পুন্নাগের সমকক্ষ কেহ নাই। ইহা বারংবার বলা হইয়াছে।