আপনাকে কি আমি চাচা ডাকতে পারি?
মিসির আলি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললেন, ডাকতে পার।
যেহেতু ইউনিভার্সিটিতে মাষ্টারি করেছেন, সবাই বোধ হয় আপনাকে স্যার ডাকে। সবাই ডাকে না, তবে অনেকেই ডাকে।
লিলি ঝুঁকে এসে বলল, আমি অনেকের মতো হতে চাই না। আমি অনেকের চেয়ে আলাদা থাকতে চাই। আমি এখন থেকে আপনাকে চাচা ডাকব।
আচ্ছা।
না চাচা ডাকব না, চাচাজী ডাকব। চাচাজী ডাকের মধ্যে আন্তরিকতা আছে। চাচা ডাকের মধ্যে নেই। তাই না?
হুঁ।
লিলি ঝুঁকে এসে বলল, জী লাগালেই যে আন্তরিক হয়ে যায় তা কিন্তু না। যেমন ধরুন, বাবাজী, বাবাজী শুনতে ফাজলামির মতো লাগে না?
লিলি মুখ টিপে টিপে হাসছে। মেয়েটাকে এখন খুবই সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে বেতের চেয়ারে একটা পরী বসে আছে। হঠাৎ মেয়েটাকে এত সুন্দর লাগছে কেন মিসির আলি বুঝতে পারলেন না। মানুষের চেহারাও কি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়? বদলাতে পারে। দিনের একেক সময় তার মুখে একেক রকম আলো পড়ে। সেই আলোর কারণেই চেহারা বদলায়। এনসেল আড়ামের একটা ফটোগ্রাফির বইতে পড়েছিলেন–তিনটা স্পট লাইট দিয়ে যে কোনো মানুষের চেহারা নিয়ে খেলা করা যায়।
চাচাজী পান মসলা খাবেন?
না।
একটু খেয়ে দেখুন খুব ভালো। আমি নিজে বানিয়েছি। আমার নিজের ফর্মুলা। আমি এই ফর্মুলার নাম দিয়েছি-লিলিস পান পাউডার। কারণ আমার জিনিসটা পাউডারের মতো। মুখে দিয়ে কুটুর কুটুর করে চাবাতে হয় না। বুড়ো মানুষ যাদের দীতের অবস্থা ভালো না।–তাদের জন্যে খুব সুবিধা। চাবাতে হবে না।
লিলি পান পাউডারের কৌটা বাড়িয়ে দিল। হাতের মুঠোর ভেতর রাখা যায় এমন কৌটা। দেখতে খুবই সুন্দর। কৌটার গায়ে ময়ূরের পালকের ডিজাইন। মনে হয় ছোট্ট একটা ময়ূর হাতের মুঠোয় শুয়ে আছে।
মিসির আলি বললেন, তোমার কৌটাটা খুব সুন্দর।
আপনার পছন্দ হয়েছে?
হ্যাঁ পছন্দ হয়েছে।
কৌটাটা আমি আপনাকে দিয়ে দিতাম, কিন্তু দেওয়া ঠিক হবে না। আপনার কাছে এই কৌটি দেখলে সবাই হিসাহসি করবে।
কেন বল তো?
কারণ কৌষ্টাটা মেয়েদের। মেয়েরা এই ধরনের কৌটায় পিল রাখে। কোন ধরনের পিল বুঝতে পারছেন তো? বাৰ্থ কনট্রোল পিল।
ও আচ্ছা।
আপনি কি আমার কথায় লজ্জা পেয়েছেন? প্লিজ লজ্জা পাবেন না; আমার স্বভাব হচ্ছে—মুখে যা আসে বলে ফেলি। চিন্তাভাবনা করে কিছু বলি না। আপনি নিশ্চয়ই আমার মতো না। আমার মনে হয় আপনি আপনার প্রতিটি কথা খুব চিন্তাভাবনা করে বলেন। ছাঁকনি দিয়ে কথাগুলি ছাঁকেন।
মিসির আলি ঘড়িত দিকে তাকিয়ে বললেন, লিলি তুমি তোমার জরুরি চিঠিটা আমাকে দিয়ে দাও। আমার আজ একটু বের হতে হবে। আমার কিছু কেনাকাটা আছে।
কেরোসিনের চুলা কিনবেন?
মিসির আলি খুবই চমকালেন, কিন্তু মুখের ভাবে কিছুই প্রকাশ করলেন না। তিনি কেরোসিনের চুলা ঠিকই কিনবেন, কিন্তু এই তথ্য মেয়েটির জানার কথা না। টেবিলের উপর কোনো কাগজের টুকরাও নেই, যেখানে কেরোসিনের চুলা লেখা। থটি রিডিং জাতীয় কিছু? সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ। ইএসপির কথা খুব শোনা যায়। বাস্তবে দেখা যায় না?
মিসির আলি মনের বিস্ময় চেপে রেখে বললেন, হ্যাঁ একটা কেরোসিনের চুলা কিনব।
আমি যে বলে দিতে পারলাম। এতে অবাক হন নি?
প্ৰথমে অবাক হয়েছিলাম। এখন অবাক হচ্ছি না।
এখন অবাক হচ্ছেন না কেন? আমি কীভাবে কেরোসিনের চুলার ব্যাপারটা বলে ফেলেছি তা ধরে ফেলেছেন–এই জন্যে অবাক হচ্ছেন না?
হ্যাঁ।
আচ্ছা বলুন, আমি কীভাবে বলতে পারলাম কেরোসিনের চুলা?
আমি লক্ষ করেছি। তুমি কথা বলার সময় যতটা না। আমার চোখের দিকে তাকাও তারচেয়ে বেশি তাকাও আমার ঠোটের দিকে। কথা বলার সময় ঠোঁটের দিকে তোকানোর প্রয়োজন পড়ে না, কারণ শব্দটা আমরা কানে শুনতে পাই। তুমি ঠোঁটের দিকে তাকাচ্ছ তার মানে তুমি লিপ রিডিং জোন। আমি নিশ্চয়ই তোমার সঙ্গে কথা বলার সময় বিড়বিড় করে কেরোসিনের চুলা বলেছি। তুমি ঠোঁট নাড়া দেখে বুঝে ফেলেছি।
লিলি হাসতে হাসতে বলল, আপনাকে আমি দশে সাড়ে নয় দিলাম। আসলেই আপনার বুদ্ধি আছে।
তোমার কি ধারণা হয়েছিল বুদ্ধি নেই?
আপনাকে তো আমি খুব ভালোমতো জানি না। যা জানি বইপত্র পড়ে জানি। বইপত্রে সব সময় বাড়িয়ে বাড়িয়ে লেখা হয়। তাছাড়া চাচাজী আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনার চেহারায় হালকা বোকা ভাব আছে। আপনি নিজে তো নিজেকে আয়নায় দেখেন। ঠিক বলছি না চাচাজী?
হ্যাঁ ঠিক বলছ।
আমি বুঝতে পারছি আমাকে বিদায় করতে পারলে আপনি খুশি হন। আমি আর মাত্ৰ বারো মিনিট থাকব। তারপর চলে যাব।
হিসাব করে বারো মিনিট কেন?
লিলি হাসিমুখে বলল, একটা বাজার ঠিক দশ মিনিট পরে আপনাকে আমি চিঠিটা দেব। এই চিঠি আগেও দেওয়া যাবে না, পরেও দেওয়া যাবে না। একটা বাজার ঠিক দশ মিনিট পরেই দিতে হবে। কারণটা হচ্ছে আজ মে মাসের ছয় তারিখ। এই তারিখে সূৰ্য ঠিক মাথার উপর আসবে একটা বেজে দশ মিনিটে। যিনি চিঠিটা আমার কাছে দিয়েছেন, তিনি এইসব বিষয় খুব ভালো জানেন। সূৰ্য মাথার উপর আসার ব্যাপারটা আমি তার কাছ থেকে জেনেছি।
চিঠিটা কে দিয়েছে তোমার হাজবেন্ড?
জী।
তার শখ কি আকাশের তারা দেখা? যারা আকাশের তারা দেখে এইসব ব্যাপার তারাই খুব ভালো জানে।
হ্যাঁ তিনি আকাশের তারা দেখেন। তাঁর তিন-চারটা টেলিস্কোপ আছে। আচ্ছা চাচাজী বইপত্রে পড়ি আপনার অবজারভেশন ক্ষমতা অস্বাভাবিক। দেখি তো কেমন? আমাকে দেখে আমার হাজবেন্ড সম্পর্কে বলুন। বলা কি সম্ভব?