পুঁই পাতা পাওয়া যায় নি কথাটা সত্যি না। পাতা পাওয়া গেছে। সেই পাতায় কৈ মাছের পাতুড়ি রান্না হয়েছে। লিলি মিসির আলির পাতে মাছ তুলে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল-দেখলেন কেমন বোকা বানালাম!
আয়োজন প্রচুর। মাছই আছে তিন রকমের। চিংড়ি মাছ, মলা মাছ আর কৈ মাছ। নানান ধরনের ভর্তা, ভাজি। কুচকুচে কালো রঙের একটা ভর্তা দেখা গেল। আরেকটার বর্ণ গাঢ় লাল। পাশাপাশি দুটা বাটিতে লাল এবং কালো ভর্তা রাখা হয়েছে যার থেকে ধারণা করা যায় যে শুধু রান্না না, খাবার সাজানোর একটা ব্যাপারও মেয়েটার মধ্যে আছে। লিলি বলল, চাচাজী এই দেখুন কালো রঙের এই বস্তু হল কালিজিরা ভর্তা। কৈ মাছের পাতুড়ি আপনার পাতে তুলে দিয়েছি বলেই এটা দিয়ে খাওয়া শুরু করবেন না। কালিজিরা দিয়ে কয়েক নলা ভাত খেলে মুখে রুচি চলে আসবে। তখন যাই খাবেন, তাই ভালো লাগবে।
মিসির আলি বললেন, আমার রুচির কোনো সমস্যা নেই। তারপরেও তুমি যেভাবে খেতে বলবে আমি সেইভাবেই খাব। লাল রঙের বস্তুটা কী?
মরিচ ভর্তা। শুকনো মরিচের ভর্তা।
আমি কাল খেতে পারি না।
এই মরিচ ভতাঁর বিশেষত্ব হচ্ছে ঝাল নেই বললেই হয়। বিশেষ প্রক্রিয়ায় শুকনো মরিচ থেকে ঝাল দূর করা হয়েছে। বিশেষ প্রক্রিয়াটা শুনতে চান?
শুনে আমার কোনো লাভ নেই, তবু বল।
শুকনো মরিচ লেবু পানিতে ড়ুবিয়ে রাখলে মরিচের ঝাল চলে যায়। ভিনিগারে ড়ুবিয়ে রাখলেও হয়। আমি ঝাল দূর করেছি লেবু পানিতে ড়ুবিয়ে।
বিচিত্র ধরনের রান্নাবান্না তুমি কি কারো কাছ থেকে শিখেছি? না নিজে মাথা খাটিয়ে বের করেছ?
বেশির ভাগ রান্নাই আমি আমার নানির কাছ থেকে শিখেছি। নানি আমাকে রান্না শিখিয়েছেন, তার চেয়েও বড় কথা রান্নার মন্ত্র শিখিয়েছেন। আমি প্রায় কুড়িটার মতো রান্নার মন্ত্র জানি।
মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, রান্নার কি মন্ত্র আছে নাকি?
লিলি সহজ ভঙ্গিতে বলল, হ্যাঁ মন্ত্র আছে। এই মন্ত্র কাউকে শেখানো নিষেধ। মন্ত্র শেখালে তার পাওয়ার চলে যায়। কিন্তু আপনি চাইলে আপনাকে শেখাব।
আমি রান্না শিখতে চাচ্ছি না। কিন্তু মন্ত্রটা শিখব।
মন্ত্রটা সত্যি শিখতে চান?
শিখতে চাই না, শুধু শুনতে চাই। যেকোনো একটা মন্ত্র বললেই হবে।
লিলি বলল, একেক রান্নার একেক মন্ত্র। ছোট মাছ রান্নার মন্ত্রটা বলি। ছোট মাছের সঙ্গে তেল মশলা মাখাতে হয়। চুলায় হাঁড়ি দিয়ে আগুন দিতে হয়। হাঁড়ি পুরোপুরি গরম হবার পর তেল-মশলা মাখা মাছটা হাঁড়িতে দিয়ে মন্ত্রটা পড়তে হয়। দশবার। তারপর পানি দিতে হয়। পানি এমনভাবে দিতে হয় যেন মাছের উপর দু আঙুল পানি থাকে। এই মন্ত্রের দাম দশ-দুই মন্ত্র। পানি ফুটতে শুরু করলেই রান্না শেষ। আরেকবার মন্ত্রটা পড়ে ফুঁ দিয়ে হাঁড়ির মুখ বন্ধ করে হাঁড়ি নামিয়ে ফেলতে হবে। তরকারি বাটিতে ঢালার আগে আর ঢাকনা নামানো যাবে না।
এখন মন্ত্রটা বল। লিলি বলল, মন্ত্রটা অনেক লম্বা। শুরুটা এরকম–
উত্তরে হিমালয় পৰ্বত
দক্ষিণে সাগর
নদীতে সপ্ত ডিঙ্গায়
চাঁদ সদাগর।
আমি চুলার ধারে
ধোঁয়া বেশুমার
অগ্নিবিনা রন্ধন হবে
প্রতিজ্ঞা আমার।
অগ্নি আমার ভাই
জল আমার বোন
আমি কন্যা চম্পাবতী
শোন মন্ত্র শোন।
আশ্বিনে আশ্বিনা বৃষ্টি
কার্তিকে হিম
শরীরে দিয়াছি বন্ধন
আলিফ লাম মিম।
…
মিসির আলি মন্ত্র শুনে হাসলেন। লিলি বলল, চাচাজী হাসবেন না। এই মন্ত্র পড়ে। একবার ছোট মাছ রান্না করে দেখুন। দশবার মন্ত্র পড়ার পর দু আঙুল পানি। আর কিছু লগবে না।
মিসির আলি বললেন, লিলি আমার ধারণা মন্ত্রটা হল-টাইমিং। সেই সময় তো গ্রামেগঞ্জে ঘড়ি ছিল না। রান্নার মতো তুচ্ছ বিষয়ে ঘড়ির ব্যবহারের প্রশ্নই আসে না। আমার ধারণা তখন মন্ত্র পড়ে সময়ের হিসাব রাখা হত। তুমি যে মন্ত্রটা বললে এই মন্ত্র দশবার বলতে যত সময় লাগে অতটা সময় তেল-মশলা মাখানো মাছ গরম চুলায় রাখলেই হবে। তুমি এক কাজ কর। ঘড়ি দেখে দশবার মন্ত্র পড়তে কত সময় লাগে সেটা বের কর। তারপর মন্ত্র ছাড়া সময় দেখে রান্না কর। দেখবে রান্না ঠিকই হয়েছে।
লিলি বলল, আপনার আসলেই অনেক বুদ্ধি। মন্ত্র যে কিছুই না, সময়ের হিসাব এটা আমিও টের পেয়েছি। কিন্তু আমার অনেক সময় লেগেছে। আপনি সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলেছেন। আপনি কি যেকোনো সমস্যার সমাধান সঙ্গে সঙ্গে করে ফেলেন? এই ক্ষমতা কি সত্যি আপনার আছে?
মিসির আলি কিছু বললেন না। তিনি লক্ষ করলেন লিলি তীক্ষ্ণ চোখে তাকে দেখছে। সে কি কিছু বলার চেষ্টা করছে? প্রশ্নের ভেতরেও লুকানো প্রশ্ন থাকে। মেয়েটির এই প্রশ্নের ভেতর লুকানো কোনো প্রশ্ন কি আছে?
লিলি বলল, মিষ্টি জাতীয় কিছু রান্না করিনি। আপনি কি মধুখাবেন? মধু এনে দেব? ঐ দিন খলসা ফুলের মধু খেয়েছেন, আজ কেওড়া ফুলের মধু খান।
না।
লিলি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, আপনি কি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চান? জিজ্ঞেস করতে চাইলে করতে পারেন।
মিসির আলি বললেন, সুলতান চিঠিতে একটা মেয়ের কথা বলেছিল ঐ মেয়েটি সত্যি আছে? সালমা নাম, পনের ষোল বছর বয়স। অতীন্দ্ৰিয় ক্ষমতাসম্পন্ন মেয়ে।
লিলি সহজ গলায় বলল, থাকবে না কেন আছে। দূরবীনওয়ালাকে বললেই সে আপনাকে দেখাবে।
মিসির আলি বললেন, মেয়েটা থাকে কোথায়?
লিলি বলল, মেয়েটা কোথায় থাকে তা দিয়ে কী করবেন? মেয়েটার সত্যি কোনো ক্ষমতা আছে কিনা এটা জানা জরুরি। তাই না?