সুলতান কঠিন গলায় বলল, অশ্বিনী কুমার একজন সিরিয়াল কিলার। সে ঠাণ্ডী মাথায় একের পর এক মানুষ খুন করেছে। খুনগুলি করেছে অতি প্রিয়জনদের। নিজের কন্যা। তাকে আমার পছন্দ হবে কেন?
মানুষের পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারটা অত্যন্ত বিচিত্র। মানুষ সুন্দর যেমন পছন্দ করে, অসুন্দরও করে।
সবাই করে না। কেউ কেউ হয়তো করে।
সুন্দরের পূজাও সবাই করে না। কেউ কেউ করে।
সুলতান অসহিষ্ণু গলায় বলল, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন পরিষ্কার করে বলুন।
মিসির আলি শান্ত গলায় বললেন, আমার ধারণা অশ্বিনী বাবুর ব্যাপারটা তোমার মাথায় ঢুকে গেছে। তুমি তার মতো করে জীবন যাপন করতে চাচ্ছি। তুমি আকাশের তারা দেখ কারণ অশ্বিনী বাবু দেখতেন।
সুলতান কঠিন গলায় বলল, আপনাকে কে বলল অশ্বিনী বাবু তারা দেখতেন?
মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, আমাকে কেউ বলে নি। আমি অনুমান করছি। এই অনুমানের পেছনে ভিত্তি আছে। তোমার সঙ্গে গল্প করার ফাঁকে ফাঁকে আমি লাইব্রেরিতে সাজানো বইগুলির উপর চোখ বুলিয়েছি। চামড়ায় বাঁধানো, সোনার জলে নাম লেখা বেশ কিছু পুরোনো বই দেখলাম। আকাশের তারা নিয়ে লেখা দুটা বই চোখে পড়েছে। একটার নাম তারা পরিচিতি, আরেকটার নাম-আকাশ পৰ্যবেক্ষণ। একটা ইংরেজি বই আছে western Hemisphere Stars, এখন তুমি বল এই বইগুলি কি অশ্বিনী বাবুর?
হ্যাঁ।
উনি কি আকাশ দেখতেন?
হ্যাঁ দেখতেন। তাঁর একটা দূরবীন ছিল। ম্যাক এলেষ্টার কোম্পানির চোঙ দূরবীন। উনি তারা দেখতেন বলেই কি তুমি এখন তারা দেখছ?
সুলতান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিচু গলায় বলল, না ব্যাপারটা সে রকম না। আকাশের বিষয়ে আমার কৌতূহল ছোটবেলা থেকেই ছিল। তবে অশ্বিনী বাবুর লেখা ডায়েরি পড়ে আমি টেলিস্কোপ কিনতে আগ্রহী হই এটা ঠিক। তিনি আকাশ দেখতেন এবং কী দেখলেন তা খুব গুছিয়ে লিখে রাখতেন। পড়তে ভালো লাগে। তার মানে এই না যে আমি তাঁর জীবনযাত্রা অনুসরণ করছি। আপনি নিশ্চয়ই বলবেন না–মন্দিরে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, এখন আমি মানুষ বলি দেয়া শুরু করব?
মিসির আলি বললেন, অশ্বিনী বাবুর লেখা ডায়েরিটা কি আমি পড়তে পারি?
অবশ্যই পড়তে পারেন। আপনি কিন্তু স্যার আমার প্রশ্নের জবাব দেন নি।
প্রশ্নটা যেন কী?
প্রশ্নটা হল—আপনার কি ধারণা আমিও মানুষ বলি দিচ্ছি? গ্ৰাম থেকে মানুষ ধরে এনে গোপনে বলি দিয়ে মন্দিরের পেছনের কুয়ায় ফেলে দিচ্ছি? আমাকে কি অসুস্থ মানুষ বলে মনে হচ্ছে?
মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ছোটখাটো অসুখগুলি চট করে ধরা যায়। কিন্তু ভয়ঙ্কর অসুখগুলি মানুষের মস্তিষ্কের গভীরে বাস করে। এদের চট করে ধরা যায় না। যেমন অশ্বিনী বাবুর কথাই ধরা যাক–তীর ভয়ঙ্কর অসুখ ধরতে অনেক সময় লেগেছিল। অশ্বিনী বাবুর সবচেয়ে কাছের মানুষ তাঁর স্ত্রী পর্যন্ত ধরতে পারেন নি। তিনটি মেয়ের মৃত্যুর পর ধরতে পারলেন।
সুলতান হতভম্ব গলায় বলল, স্যার আপনি তো দেখি সত্যি সত্যি আমাকে অশ্বিনী বাবুর দিলে ফেলে দিয়েছেন। ঠিক করে বলুন তো আপনি আমার সম্পর্কে কী ভাবছেন?
এখন পর্যন্ত আমি কিছুই ভাবছি না। তবে আমার অবচেতন মন নিশ্চয়ই ভাবছে। অবচেতন মনের কর্মকাণ্ড খুব অদ্ভুত। অবচেতন মনকে মাঝে মাঝে আমার কাছে আত্মভোলা শিশুর মতো মনে হয়। যে শিশু নিজের মনে খেলছে। জিগ স পাজলের খেলা। একটা টুকরার সঙ্গে আরেকটা টুকরা জোড়া দিয়ে ছবি বানাচ্ছে। ছবি ভেঙে ফেলছে। আবার বানাচ্ছে। মাঝে মাঝে অদ্ভুত কোনো ছবি তৈরি হয়ে গেলে অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ ছবির দিকে তাকিয়ে আবার সেই ছবিও নষ্ট করে ফেলছে।
সুলতান শান্ত গলায় বলল, স্যার শুনুন, আমার কোনো হচবি দাঁড় করাতে হলে সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস করলেই হবে। আমি জবাব দেব। অনুমানের উপর কিছু দাড় করানোর প্রয়োজন নেই।
মিসির আলি বললেন, অবচেতন মন কাউকে জিজ্ঞেস করে কাজ করে না। জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি চেতন মনের, অবচেতন মনের না। তবে চেতন মন থেকে সে যে তথ্য নেয় না, তা না। তথ্য নেয়। যেটা তার পছন্দ তাই নেয়, সব তথ্য নেয় না।
সুলতান ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, স্যার আমার নিজের ধারণা এই বাড়িটা আপনার উপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। জেলখানার মতো উঁচু পঁচিলে ঘেরা বিরাট বাড়ি। গেট সব সময় তালাবন্ধ। তিনটা কুকুর বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। আপনার ধারণা হয়েছে আপনি বন্দি হয়ে গেছেন। যেই মুহুর্তে মানুষ নিজেকে বন্দি ভাবে সেই মুহূর্ত থেকে তার চিন্তার ধারা বদলে যায়। আমি যখন মুক্ত মানুষ ছিলাম তখন একভাবে চিন্তা করতাম। যেই মুহুর্তে হুইল চেয়ারে বন্দি হয়েছি সেই মুহুর্ত থেকে অন্যভাবে চিন্তা করা শুরু করেছি। আপনার বেলাতেও তাই হচ্ছে। আপনি আমাকে সহজভাবে গ্রহণ করতেই পারছেন না। আপনি ধরেই নিয়েছেন। আমি হচ্ছি হুইল চেয়ারে বসা অশ্বিনী বাবু।
মিসির আলি কিছু বললেন না। সুলতান বলল, আপনি খেতে যান। আপনার খাবার দেয়া হয়েছে।
তুমি খাবে না?
না। আমার মেজাজ খুবই খারাপ। আপনার কারণে মেজাজ খারাপ না। আকাশ মেঘে ঢাকা, তারা দেখা যাবে না। এই জন্যে মেজাজ খারাপ। মেজাজ খারাপ নিয়ে আমি খেতে পারি না। আপনি খেতে যান, আমি অশ্বিনী বাবুর ডায়েরিটা খুঁজে বের করি। তাঁর অনেক খাতাপত্রের সঙ্গে ডায়েরিটা আছে। খুঁজে বের করতে সময় লাগবে।