বরকত জবাব দিল না। চোখও নামিয়ে নিল না।
মিসির আলি বললেন, বাগান বঁট দিতে এসেছ?
বরকত বলল, না।
মিসির আলি বললেন, তোমার কুকুরগুলির সঙ্গে এখনো পরিচয় হয় নি। চল যাই কুকুরগুলির সঙ্গে পরিচিত হয়ে আসি।
বরকত বলল, আপনেরে ডাকে।
কে ডাকে?
বরকত এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বাড়ির দিকে আঙুল উঁচিয়ে দেখাল। মিসির আলি বললেন, কে ডাকছে? লিলি?
বরকত জবাব দিল না। আঙুল উঁচিয়ে রাখল। মিসির আলি আঙুল লক্ষ করে এগুলেন। বরকত এখনো হত নামাচ্ছে না। তাঁর চিহ্ন আঁকা সাইনবোর্ডের মতো হাত স্থির করে রেখেছে। তাকে দেখাচ্ছে কাকতাডুয়ার মতো।
হাতের আঙুল লক্ষ করে মিসির আলি উপস্থিত হলেন লাইব্রেরি ঘরে। বিরাট ঘর। সাধারণত লাইব্রেরি ঘরের চারদিকেই বই থাকে। এই ঘরের একদিকের দেওয়ালে বই রাখা। কোনো আলমিরা নেই। সব বই র্যাকে রাখা। র্যাকের উচ্চতা এমন যে হুইল চেয়ারে বসেই হাত বাড়িয়ে বই নেওয়া যায়।
লাইব্রেরি ঘরের ঠিক মাঝখানে হুইল চেয়ারে সুলতান বসে আছে। সুলতানের সামনে টি টেবিলের মতো ছোট্ট টেবিল। সুলতানের উল্টোদিকে আরেকটা হুইল চেয়ার।
সুলতান হাসি মুখে বলল, স্যার কেমন আছেন? মিসির আলি বললেন, ভালো।
আপনার বসার জন্যে একটা হুইল চেয়ার রেখে দিয়েছি।
তাই তো দেখছি।
সুলতান গলার স্বর গম্ভীর করে মাথা সামনের দিকে খানিকটা কুঁকিয়ে বলল, সাধারণ চেয়ার না রেখে আপনার জন্যে হুইল চেয়ার কেন রেখেছি বলতে পারবেন?
না, বলতে পারব না।
আপনি কি বিস্মিত হচ্ছেন?
সামান্য হচ্ছি।
স্যার বিস্মিত হবার কিছু নেই। আমি ব্যাখ্যা করলেই বুঝবেন আপনার জন্যে হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করাটা খুবই যুক্তিযুক্ত। আপনি চেয়ারটায় আরাম করে বসুন, আমি ব্যাখ্যা করছি।
মিসির আলি বসলেন। সুলতান বলল, চেয়ারের কনট্রোলগুলি দেখে নিন। পায়ের এখন আর আপনার কোনো ব্যবহার নেই। চেয়ার ঘোরানো, সামনে পেছনে যাওয়া, সবই এখন থেকে করবেন হাতে। কাজটা এক হাতেও করতে পারেন তবে দুটা হাত ব্যবহার করলে পরিশ্রম কম হবে।
মিসির আলি বললেন, আমার তো আর এই চেয়ারে বসে অভ্যস্ত হবার দরকার নেই। আমি বসলাম আমার মতো। আপনি হুইল চেয়ারের রহস্যটা ব্যাখ্যা করুন।
সুলতান বলল, স্যার লিলি আপনাকে চাচাজী ডাকে। সেই সূত্রে আপনি অবশ্যই আমাকে তুমি করে বলবেন।
আচ্ছা বলব।
এখন বলি কেন আপনার জন্যে হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করলাম। আমি আকাশের বিশেষ বিশেষ দিকে টেলিস্কোপ ফিট করি। তারপর আসে ফোকাসের ব্যাপারটা। টেলিস্কোপ স্ট্যান্ডে বসিয়ে এই কাজটা আমাকে করতে হয় হুইল চেয়ারে বসে। একবার টেলিস্কোপ সেট করা হয়ে গেলে সেখানে আর হাত দেওয়া যাবে না। সেটিং বদলানো যাবে না। স্যার বুঝতে পারছেন?
পারছি।
হুইল চেয়ারে বসে আমি টেলিস্কোপ সেট করলাম। তারপর হুইল চেয়ার নিয়ে সরে গেলাম-আপনি আরেকটা হুইল চেয়ার নিয়ে টেলিস্কোপের কাছে চলে এলেন। আপনাকে কষ্ট করতে হল না। আপনাকে আর দাঁড়িয়ে, হাঁটু গেড়ে কিংবা কুঁজো হয়ে টেলিস্কোপে চোখ রাখতে হবে না। হুইল চেয়ারের লজিকটা কি এখন আপনার কাছে পরিষ্কার হয়েছে?
মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, হ্যাঁ পরিষ্কার হয়েছে। খুবই যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা। ব্যাখ্যাটা চট করে মাথায় আসে না বলে শুরুতে হুইল চেয়ার দেখে একটা ধাক্কার মতো খেয়েছিলাম।
সুলতান হাসতে হাসতে বলল, আজ যেমন মন্দিরে ঢুকে আপনি একটা ধাক্কার মতো খেলেন। মন্দিরে ঢুকে দেখলেন গৌর কালীর মূর্তি দেখতে অবিকল লিলির মতো। এরও কিন্তু অত্যন্ত সরল ব্যাখ্যা আছে।
কী ব্যাখ্যা?
গৌর কালীর মূর্তি বাবু অশ্বিনী কুমার অনেক আগেই নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন। এই মূর্তিই পরে আমি বানিয়েছি। হুইল চেয়ারে বসে জীবন কাটে না। নানান ধরনের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে গিয়ে মাইকেল এঞ্জেলো হবার হাস্যকর চেষ্টা। ছেনি হাতুড়ি নিয়ে পাথর কাটাকাটি।
মূর্তিটা সুন্দর হয়েছে।
মোটেও সুন্দর হয় নি। মুখের আদালটা শুধু এসেছে। আর কিছু আসে নি। নগ্ন মূর্তি বলে আপনি লজ্জায় ভালোমতো তাকান নি। ভালোমতো তাকালে ত্রুটিগুলি ধরতে পারতেন। মূর্তির একটা হাত বড়, একটা ছোট। পায়ের প্রোপরাশন ঠিক হয় নি। হাঁটু যেখানে থাকার কথা তারচেয়ে উঁচুতে হয়েছে। আপনি এখন যদি দেখেন তাহলে ত্রুটিগুলি চোখে পড়বে। মূর্তিটা নগ্ন কেন বানিয়েছি সেই ব্যাখ্যা শুনতে চান? তারও ব্যাখ্যা আছে।
না। এর ব্যাখ্যা আমার কাছে আছে। গৌর কালীর মূর্তিটা ছিল নগ্ন। তুমি মন্দিরে গৌর কালী প্ৰতিষ্ঠা করতে চেয়েছ। অতীত ফিরিয়ে আনার চেষ্টা। ইংরেজিতে সহজভাবে বলা যায় An attempt to recreate the past.
ব্যাপারটা তাই বাবু অশ্বিনী রায়ের ঘটনাটা আমাকে খুবই আলোড়িত করে। আমার মূর্তি বানানোতেও তার একটা ছায়া পড়েছে।
মিসির আলি বললেন, তোমার কি মাঝে মাঝে নিজেকে বাবু অশ্বিনী কুমার মনে হয়?
সুলতানকে দেখে মনে হল মিসির আলির এই কথায় সে একটা ধাক্কার মতো খেয়েছে। নিজেকে সামলাতে তার সময় লাগছে। তার ভুরু কুঁচকে আছে। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। সে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বলল, এই কথাটা কেন বললেন স্যার?
এমনি বললাম, মন্দিরে মূর্তি প্রতিষ্ঠা থেকে এটা মনে হল। কোনো মানুষকে খুব বেশি পছন্দ হয়ে গেলে জীবনযাত্রায় সেই মানুষটার ছায়া পড়ে।