মামলার রায় কী হয়েছিল?
ওনার ফাঁসি হয়েছিল।
তুমি এতসব জানলে কী করে?
এই মামলা নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। আমাদের দূরবীনওয়ালা সেইসব লেখা সবই যোগাড় করেছিল। আপনি চাইলে আপনাকে খুঁজে বের করে দেবে। আপনি কি চান?
না চাই না।
লিলি বলল, আমাকে দেখে কি বুঝতে পারছেন যে আমার মনটা খুব খারাপ?
না বুঝতে পারছি না।
আমার মনটা খুবই খারাপ কারণ পুঁই পাতা পাওয়া যায় নি। বড় বড় পুঁই পাতা দিয়ে পেঁচিয়ে পাতুড়ি করতে হয়। কলাপাতা দিয়েও হয়। তবে ভালো হয় না।
মিসির আলি হেসে ফেলে বললেন, মন খারাপের কারণটা তো মনে হয় খুবই গুরুতর।
আপনার কাছে গুরুতর মনে না হতে পারে আমার কাছে গুরুতর। ও যেমন তারা দেখে, আমি করি রান্না। কোনো রাতে যদি আকাশ মেঘে ঢেকে যায় ওর প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়। ঠিক সে রকম আমি যখন রান্নার জিনিসপত্র পাই না, আমার মেজাজ খারাপ হয়। এটা কি দোষের?
না দোষের না। এত সুন্দর বাগান তুমি এখানে বেড়াতে আস না?
লিলি বলল, কখনো না। নেংটিা দেবীর আশপাশে আমি থাকব? পাগল হয়েছেন? তাছাড়া গাছপালা আমার ভালোও লাগে না। চাচাজী শুনুন আমি চলে যাচ্ছি। খবরদার আপনি কিন্তু মন্দিরের ভেতর ঢুকবেন না।
আচ্ছা ঢুকব না। তোমার স্বামীর ঘুম ভেঙেছে?
হুঁ ভেঙেছে।
তার নাশতা খাওয়া শেষ?
সে নাশতা খাবে না। দুপুরে ভাত খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়বে। ঘুম না এলে ঘুমের অষুধ খেয়ে ঘুমাবে।
কেন?
রাত জাগবে। আজ সে আপনাকে নিয়ে তারা দেখবে।
আজ কি অমাবস্যা?
আগামীকাল অমাবস্যা।
মিসির আলি বললেন, কদিন ধরেই যেমন মেঘলা যাচ্ছে–অমাবস্যার রাতে যদি আকাশে মেঘ থাকে তাহলে তো সমস্যা।
লিলি নিচুগলায় বলল, আপনার আর কী সমস্যা। সমস্যা আমার। আকাশে মেঘ দেখলে ও প্রচণ্ড রেগে যায়। হইচই করে। অমাবস্যা হল বৃষ্টির সময়। অন্যদিন বৃষ্টি না হলেও অমাবস্যার বৃষ্টি হবেই। চাঁদের আকর্ষণ বিকর্ষণের কিছু ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে। আমি জানি না। আপনি নিশ্চয়ই জানেন।
আমি জানি না।
কফির মগটা দিন আমি নিয়ে চলে যাই। দুপুরের রান্না হলে খবর দেব চলে আসবেন। এখন নিজের মনে ঘুরে বেড়ান। শুধু দয়া করে মন্দিরে ঢুকবেন না।
মিসির আলি নীল মরিচ গাছের নিচে বসলেন। কালো সিমেন্টে বাঁধানো বেদি, বসার জন্যে সুন্দর। সঙ্গে বই নিয়ে এলে পড়া যেত। দোতলায় উঠে বই আনতে ইচ্ছা করছে না। আচ্ছা গতরাতের ঘটনাটা নিয়ে কি কিছু ভাববেন! না থাক এখনো সময় হয় নি। মন্দিরের ভেতরটা একবার উঁকি দিয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে। মেয়েটা যদিও নিষেধ করেছে। নিষেধ আগ্রাহ্য করার একটা প্রবণতা হয়তো মানুষের ডিএনএর ভেতরই আছে। মানুষকে যেটাই নিষেধ করা হয়েছে সেটাই সে করেছে। ব্যাপারটা শুরু করেছিলেন আদি মানব আদম। তাঁকে কোনো ব্যাপারে নিষেধ করা হয় নি, শুধু বলা হয়েছিল-গন্ধম ফলটা খেও না। আদম প্রথম যে কাজটা করলেন সেটা হল গন্ধম ফল।
এডমন্ড হিলারির মার ছিল উচ্চতা ভীতি। তিনি তাঁর পুত্রকে বললেন, তুমি আর যা-ই কর বাড়ির ছাদে উঠবে না। সেই হিলারি এভাররেষ্টের চূড়ায় উঠে বসে থাকলেন।
মিসির আলি মন্দিরের দিকে রওনা হলেন। ভেতরে ঢোকার দরকার নেই-তিনি শুধু উঁকি দিয়ে চলে আসবেন। পরিত্যক্ত মন্দিরে সাপ থাকা স্বাভাবিক, তবে কাল রাতের ঘটনার পর দিনের সাপ তত ভয়ঙ্কর হবে বলে মনে হয় না।
মন্দিরে ঢোকার দরজাটা কাঠের। দরজায় হুক আছে। তালা লাগানোর ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু দরজায় তালা নেই। মিসির আলি ধাক্কা দিতেই দরজা খুলল। মেঝে শ্বেত পাথরের, ঝকঝক করছে। মনে হচ্ছে এই মাত্র কেউ এসে সাবান পানি দিয়ে ধুইয়ে গেছে। তার চেয়েও বিস্ময়কর ঘিটনা হল মন্দিরে আছে। গৌর কালীর নগ্ন মূর্তি।
এখানেই বিস্ময়কর সমাপ্তি না। এর চেয়েও বিস্ময়কর ব্যাপার হল মূর্তিটি দেখতে অবিকল লিলির মতো! যেন কোনো ভাস্কর এসে লিলিকে দেখে পাথর কেটে কেটে মূর্তি বানিয়েছে। কাকতালীয়ভাবে একটা মানুষের চেহারার সঙ্গে পুরোনো মূর্তির চেহারা মিলে যাবে এটা বিশ্বাসযোগ্য না। এটা খুবই অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা।
মিসির আলি মন্দির থেকে বের হলেন। চেরী গাছটার নিচে বরকত দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে শলার ঝাড়ু, বাগান কুঁট দিয়ে এসেছে। তবে সে এই মুহুর্তে বাগান ঝাট দিচ্ছে না, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিসির আলির দিকে। সেই দৃষ্টিতে কৌতূহল, বিস্ময়, আনন্দ কোনো কিছুই নেই। সে তাকিয়ে আছে মাছের মতো ভাবলেশহীন চোখে।
মিসির আলি মন্দির থেকে বের হয়ে মন্দিরের পেছনের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। বরকত চোখের দৃষ্টিতে এখনো তাঁকে অনুসরণ করছে। তাঁর দৃষ্টির আড়ালে যাবার জন্যেই মন্দিরের পেছনে চলে যাওয়া দরকার।
মন্দিরের পেছনটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। একটা কুয়া আছে। কুয়ার পাড় পাথর দিয়ে বাঁধানো। কুয়ার উপরে তারের জাফরি। সেখানে বাগান বিলাস গাছ। গাছ ভর্তি ফুল। অন্ধকার কুয়া, ফুলের কারণে আলো হয়ে আছে। নদীর কাছের বাড়িতে কখনো কুয়া থাকে না। এই কুয়াটাই প্রমাণ করে দিচ্ছে একসময় নদী অনেক দূরে ছিল। মিসির আলি কুয়ার পাড়ে উঠলেন। পানি আছে কি না দেখতে হবে। পাথর নিয়ে ফেলতে হবে।
মিসির আলি কুয়াতে পাথর ফেলতে পারলেন না। তার আগেই তাঁকে চমকে উঠতে হল, কারণ ঝাঁটা হাতে বরকত এসে দাঁড়িয়েছে। মিসির আলি বললেন, কিছু বলবে?