আচ্ছা তাঁকে জিজ্ঞেস করব।
লিলি বলল, আমি ঐ দিনের মতো এক্সপ্রেসো কফি বানিয়ে আপনার জন্যে নিয়ে আসছি। ঠিক আছে চাচাজী?
ঠিক আছে।
মিসির আলি বাড়ি দেখতে বের হলেন। রাতে বাড়িটা যত প্ৰকাণ্ড মনে হয়েছিল। দিনের আলোয় মনে হচ্ছে তার চেয়েও প্ৰকাণ্ড। তবে প্ৰকাণ্ড হলেও ধ্বংসস্তুপ। বাড়িটা যেন অপেক্ষা করছে কখন হুমড়ি খেয়ে পড়বে। বাড়িটার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না! ভয় ভয় করে। মনে হয় বাড়িটাও কৌতূহলী চোখে তাঁকে দেখছে। চিন্তাভাবনা করছে। চিন্তা ভাবনা শেষ হলেই বাড়ি গম্ভীর গলায় ডাকবে, এই যে ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে, দয়া করে শুনে যান।
মিসির আলি বাড়ির পেছনে চলে গেলেন। তিনি বৃক্ষপ্রেমিক না। গাছপালা নিয়ে ষ্ঠার বাড়াবাড়ি কৌতূহল নেই, কিন্তু নীল মরিচ ফুল গাছটা দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে।
বাড়ির পেছনের জায়গাটা আশ্চর্যরকমভাবে পরিষ্কার। ঝোপঝাড় নেই, বড় বড় ঘাস নেই, গাছের নিচে শুকনো পাতা পড়ে নেই। মনে হচ্ছে এই কিছুক্ষণ আগে ঝাট দেওয়া হয়েছে। নীল মরিচ ফুল গাছটা দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। এমন কিছু বিস্ময়কর গাছ বলে মনে হচ্ছে না। তবে মরিচ ফুল গাছের পাশেই চেষ্ট্ৰী গাছ ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। পাতাশূন্য গাছ সাদা ফুলে ঢেকে আছে। মিসির আলি বিস্মিত গলায় বললেন, বাহ সুন্দর তো!
চেরী গাছের পাতা শীতকালে ঝরে যায়। এখন শীত না, তারপরেও গাছে একটা পাতা নেই কেন? জন্মভূমি ছেড়ে অন্যদেশে এসে গাছের জিনে কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে? নাকি এটা চেরী গাছ না, অন্য কোনো গাছ। তিনি নাম জানেন না।
ভাঙা মন্দিরটা দেখা যাচ্ছে। মন্দিরের অংশটা ঝোপঝাড়ে ঢাকা। বড় বড় কয়েকটা আম গাছ জায়গাটা অন্ধকার করে রেখেছে। উইয়ের টিবির মতো কিছু উঁচু মাটি দেখা গেল। মন্দিরের ঠিক সামনে সারি করে লাগানো জবা গাছ। জবা গাছ। এত বড় হতে মিসির আলি দেখেন নি। গাছগুলি আম কঁঠালের গাছের মতোই প্ৰকাণ্ড। একটা গাছেই শুধু ফুল ফুটেছে। কালচে লাল রঙের ফুল! দেখতে ভালো লাগে না। জবা ফুল ছাড়া কালী পূজা হয় না। পূজার ফুলের জন্যই কি এই গাছগুলি লাগানো? এত প্রাচীন গাছ? মিসির আলি মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলেন।
মন্দিরের গায়ে শ্বেত পাথরের ফলকে কী সব লেখা। পড়তে ইচ্ছা করছে।
বাবু অশ্বিনী কুমার রায়
কর্তৃক
অদ্য শনিবার বঙ্গাব্দ ১২০৮ গৌর কালীমূর্তি অধিষ্ঠিত হইল।
মিসির আলি নামফলকের দিকে তাকিয়ে আছেন। গৌর কালীমূর্তি ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না। কালী কৃষ্ণবর্ণ, গৌরবর্ণ না।
চাচাজী আপনার কফি। আপনাকে বলা হয়েছে মন্দিরের কাছে না। আসতে আর আপনি সোজাসুজি মন্দিরে চলে এসেছেন। আপনি দেখি একেবারে বাচ্চাদের মতো। যেটা করতে না করা সেটাই করেন।
মিসির আলি কফির মগ হাতে নিতে নিতে বললেন, গৌর কালী ব্যাপারটা কী?
গৌর কালী হল যে কালীর গায়ের রঙ গৌর। ধবধবে সাদা। বাবু অশ্বিনী রায় স্বপ্নে দেখেছিলেন মা কালী তাকে বলছেন-তুই আমাকে প্রতিষ্ঠা কর। তবে গায়ের রঙ কালো করিস না বাবা। গৌর বর্ণ করবি। অশ্বিনী কুমার রায় বললেন, ঠিক আছে মা করব। দেবী তখন বললেন, আমি তোর এখানে থাকব নগ্ন অবস্থায়। আমার গায়ে যেন কোনো কাপড় না থাকে। অশ্বিনী কুমার রায় বললেন, সেটা কি ঠিক হবে মা? কত ভক্তরা তোমাকে দেখতে আসবে! দেবী বললেন, কেউ আমাকে দেখতে আসবে না। তোকে যা করতে বললাম তুই কর।
মিসির আলি বললেন, অশ্বিনী কুমার নগ্ন গৌরবর্ণের কালী প্রতিষ্ঠা করলেন?
লিলি বলল, হ্যাঁ।
মন্দিরে কি মূর্তি আছে?
না। অশ্বিনী কুমার রায় নিজেই মূর্তিটা মেঘনায় ফেলে দিয়েছিলেন।
কেন?
গল্পটা আমি পুরোপুরি জানি না। ভাসা ভাসা জানি। দূরবীনওয়ালা, অর্থাৎ সুলতান সাহেব ভালোমতো ও আপনাকে গুছিয়ে বলবে।
আগে থেকে অগোছালোভাবে শুনি। অগোছালো গল্প শুনতেই আমার বেশি ভালো লাগে।
ঘটনাটা হল এ রকম–যেদিন দেবী প্রতিষ্ঠিত হল সেই রাতেই অশ্বিনী বাবুকে দেবী স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন, এই বোকা ছেলে! নরবলি ছাড়া শক্তির প্রতিষ্ঠা হয়? তুই এক কাজ করা, আগামী অমাবস্যার নরবলি দে। অশ্বিনী বাবু বললেন, এইটা পারব না। মা। আমি মহাপাতক হব। দেবী বললেন, পাপ-পুণ্যের তুই বুঝিস কী? তোকে যা করতে বললাম কর। নয়তো মহাবিপদে পড়বি। অশ্বিনী বাবু স্বপ্নের মধ্যেই কাঁদতে কাঁদতে বললেন, এই কাজটা পারব না মা। নরবলি ছাড়া তুমি যা করতে বলবে তাই করব। দেবী তখন বললেন, তুই যখন পারবি না। তখন আমার ব্যবস্থা আমিই করব। তখন তোর দুঃখের সীমা থাকবে না। অশ্বিনী বাবুর ঘুম ভেঙে গেল। দুশ্চিন্তায় তিনি অস্থির হয়ে গেলেন। খুবই কান্নাকাটি শুরু করলেন। আগামী অমাবস্যার না জানি কী হয়!
কিছু হয়েছিল?
হ্যাঁ হয়েছিল। অশ্বিনী বাবুর বড় মেয়েকে মন্দিরের ভেতর পাওয়া গেল। বড় মেয়ের নাম শ্বেতা। বয়স আঠার উনিশ। বিয়ের কথা চলছিল। সকালে মন্দিরে ঢুকে অশ্বিনী বাবু দেখেন, মেয়ের মাথা একদিকে ধড় আরেক দিকে। দেবীর খাড়ায় চাপ চাপ রক্ত।
কী সৰ্বনাশ!
অশ্বিনী বাবুর মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল। তিনি সেই রাতেই দেবীমূর্তি মেঘনা নদীর মাঝখানে ফেলে দিয়ে এলেন।
উনার কি একটাই মেয়ে ছিল?
ওনার চার মেয়ে ছিল। দুমাসের মাথায় দ্বিতীয় মেয়েটিরও একই অবস্থা হল। মন্দিরের ভেতর তাকে পাওয়া গেল মাথা একদিকে ধড় আরেক দিকে। অশ্বিনী বাবু বাড়িঘর বিক্রি করে বাকি দুই মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে প্রথমে গেলেন ডিব্ৰুগরে, সেখান থেকে শিলিগুড়িতে। শিলিগুড়িতে তাঁর তৃতীয় মেয়েটির একই অবস্থা হল। তখন তাঁর স্ত্রী সীতাদেবী মামলা করলেন স্বামীর বিরুদ্ধে। সীতাদেবী বললেন, হত্যার ঘটনাগুলি তার স্বামী ঘটাচ্ছেন। দোষ দিচ্ছেন মা কালীর। ছোট মেয়েটাও বাবার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিল।