তিনি দরজায় ছিটিকিনি না দিয়েই শুয়েছিলেন। পুরোনো আমলের বাড়ি ছিটিকিনি জং ধরে আটকে গিয়েছিল। যেহেতু ছিটিকিনি লাগানো নেই, আংটা ধরে টানলেই দরজা খুলে যাবার কথা। কিন্তু আশ্চর্য দরজা খুলতে পারলেন না। প্রাণপণে টেনেও দরজা নাড়ানো গেল না। মনে হচ্ছে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। তিনি বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলেন। কোনো লাভ হল না। মিসির আলি খাটে এসে উঠলেন। হইচই চিৎকার করার কোনোই মানে হয় না। পুরো ব্যাপারটা স্বপ্ন হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কাজেই তার যা করণীয় তা হল বিছানায় চলে যাওয়া। ঘুমিয়ে পড়া এবং ঘুম ভাঙার জন্যে অপেক্ষা করা।
মিসির আলি বিছানায় শুয়ে পড়লেন। শীত শীত লাগছে। পায়ের কাছে রাখা চাঁদ র বুক পর্যন্ত টেনে দিলেন। একটা হাত রাখলেন কোলবালিশের উপর। তিনি চোখ বন্ধ করে আছেন। মাথার ভেতরে সমুদ্র গর্জনের মতো শব্দ হচ্ছে। এ রকম শব্দ কেন হচ্ছে কে জানে? প্রচণ্ড ভয় পাবার পরে কি মানুষের শারীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ড খানিকটা এলোমেলো হয়ে যায়?
তাঁর ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। ঘর ভর্তি আলো। পাখপাখালি চারদিকে কিচকিচ করছে। খাটের পাশে লিলি দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে চায়ের কাপ। আজ মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে তার বয়স কিছুতেই সতের আঠার বছরের বেশি হবে না। লিলি হাসিমুখে বলল, চাচাজী আপনি দরজার ছিটিকিনি না লাগিয়েই ঘুমিয়েছেন? মিসির আলি উঠে বসতে বসতে বললেন, ছিটিকিনি লাগাতে পারি নি। লিলি বলল, আমি তো আর সেটা জানি না। এর আগেও দুবার এসে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেছি। এইবার কী মনে করে দরজা ধাক্কা দিলাম। ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। চাচাজী রাতে ঘুম কেমন হয়েছে?
ভালো।
নিন চা নিন। আমি বইয়ে পড়েছি আপনি বাসিমুখে দিনের প্রথম চা খান। নাশতা তৈরি আছে! হাত মুখ ধুয়ে নিচে নামলেই নাশতা দিয়ে দেব।
তোমার শরীর এখন ভালো?
শরীর খুব ভালো। কাল রাতেও ভালো ছিল। ওর সঙ্গে রাগারণি করে বিছানায় শুয়ে পড়েছিলাম। ও আপনাকে কী বলেছে? আমার মাথা খারাপ? আমার চিকিৎসা দরকার?
এই ধরনেরই কিছু।
লিলি হাসতে হাসতে বলল, ওর কোনো দোষ নেই। রাগারগির এক পর্যায়ে আমি মাথা খারাপের অভিনয় করেছি। ও আমার অভিনয় ধরতে পারে না। চাচাজী আমার চা কেমন হয়েছে?
ভালো হয়েছে।
কাল রাতের খাবারটা কেমন ছিল?
ভালো ছিল। আমি খুব তৃপ্তি করে খেয়েছি।
আজ। আপনাকে কই মাছের পাতুড়ি খাওয়াব। পুঁই শাকের পাতা আনতে পাঠিয়েছি। পাওয়া গেলে হয়। এমন জংলা জায়গায় বাস করি। আশপাশের দুতিন মাইলের মধ্যে হাটবাজার নেই।
মিসির আলি কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, লিলি একটা কাজ কর তো–টেবিলের উপর দেখ আমার ডায়েরিটা উল্টো করে রাখা আছে। পাতাটা খুলে দেখা কী লেখা।
লিলি টেবিলের কাছে গেল। ডায়েরি উলটো করে রাখা নেই। বইগুলির উপর রাখা। লিলি বলল, চাচাজী টেবিলের উপর কোনো ডায়েরি উল্টো করে রাখা নেই।
লাল মলাটের বইটি ডায়েরি। সাত তারিখ বের করে দেখ তো কিছু লেখা আছে কি না।
লিলি অবাক হয়ে বলল, কিছু লেখা নেই। কী লেখা থাকবে?
মিসির আলি হালকা গলায় বললেন, রেখে দাও। কিছু লেখা থাকবে না। তোমার স্বামীর ঘুম কি ভেঙেছে?
ওর ঘুম একটার আগে ভাঙবে না। সারা রাত জেগে তারা দেখেছে। আপনাকে কী কী দেখাবে সব ঠিকঠাক করেছে। আজ। আপনাকে কী দেখানো হবে জানেন?
না।
শনির বলয়। এইসব দেখে কী হয় কে জানে! আমার খুবই ফালতু লাগে। চাচাজী আমি নিচে যাচ্ছি। হাতমুখ ধুয়ে আপনি নেমে আসুন। আজ আপনি নাশতা থাবোন চুলার পাশে বসে। গরম গরম লুচি ভেজে পাতে তুলে দেব।
তোমার লুচিগুলিও কি স্পেশাল?
অবশ্যই। অর্ধেক ময়দা আর অর্ধেক সুজিদানা মিশিয়ে কাই তৈরি করা হয়। দশ বারো ঘণ্টা এই কাই ভেজা ন্যাকড়ায় জড়িয়ে রেখে দিতে হয়। লুচির কাই আমি কাল রাতেই তৈরি করে রেখেছি।
ভালো।
শুধু ভালো বললে হবে না। আপনি চলে যাবার আগে আমাকে একটা সার্টিফিকেট দিয়ে যাবেন। রান্নার সার্টিফিকেট। সেই সার্টিফিকেট আমি বাঁধিয়ে রাখব।
অবশ্যই দিয়ে যাব। তুমি চাইলে এখনি দিয়ে দিতে পারি।
ওমা এখন কেন দেবেন? আমি তো এখনো আপনার জন্যে রান্নাই করি নি। চাচাজী যাই।
লিলি চলে যাবার পর মিসির আলি টেবিলের কাছে গেলেন। ডায়েরি হাতে নিলেন। সেখানে স্বপ্নের কথা লেখা নেই। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালা? গত রাতে যা দেখেছেন সবই স্বপ্ন? গাঢ় স্বপ্ন?
মিসির আঁলি হাত মুখ ধুয়ে নিচে নামলেন। লুচি বেগুনভাজা খেলেন। চা খেলেন। লিলি বলল, চাচাজী আপনি ঘুরে ফিরে বাড়ি দেখুন। বাগান দেখুন। লাইব্রেরি ঘর খুলে রেখেছি। লাইব্রেরির বইপত্র দেখতে পারেন।
তোমার কুকুরগুলি কি বাঁধা আছে?
হ্যাঁ কুকুর বাঁধা। বরকতকে পুঁই পাতার খোঁজে পাঠিয়েছি। বড় বড় পুঁই পাতা ছাড়া পাতুড়ি হয় না। বরকত এলেই কুকুরগুলির সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেব। তখন আপনার কুকুরভীতি থাকবে না।
নীল ফুল ফোটে ঐ গাছটা কোথায়?
পেছনের বাগানে। বিশাল গাছ আপনি দেখলেই চিনতে পারবেন। গাছের গুঁড়িটা বাঁধানো। পেছনের বাগানে একটা ভাঙা মন্দির আছে। মন্দিরে ঢুকবেন না। সাপের আড্ডা।
কী মন্দির?
কালী মন্দির। হিন্দু বাড়ি ছিল। বাড়ির মালিক অশ্বিনী রায় শাক্ত মতের মানুষ ছিলেন। স্বপ্নে দেখে তিনি কালী প্রতিষ্ঠা করেন। খুবই ইস্টারেস্টিং গল্প। আমি ভাসা ভাসা জানি। সুলতানকে জিজ্ঞেস করলেই আপনাকে বলবে।