অস্বাভাবিক না। মেয়ে মাত্রই নিজেকে রহস্যময়ী হিসেবে উপস্থিত করতে চায়। মেয়েটি বুদ্ধিমতী। সে নানানভাবে আমার বুদ্ধির হিসেব নিতে চাচ্ছে। দাঁড়িপাল্লায় বুদ্ধি মাপতে চাচ্ছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আমার বুদ্ধির ব্যাপারটা তার কাছে জরুরি। কেন জরুরি? সে কি আমার বুদ্ধি ব্যবহার করতে চায়? কোথায় ব্যবহার করবে…
এই পর্যন্ত লিখে মিসির আলি হাই তুললেন। তার ঘুম পাচ্ছে। এখন ঘুমানো যায়।
বিস্ময়কর ঘটনা
মিসির আলি বিড়বিড় করে বললেন, This is a dream. Nothing but a dream. যে বিস্ময়কর ঘটনা এই মুহুর্তে তাঁর চোখের সামনে ঘটছে সেটা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। স্বপ্নে বিস্ময়কর ঘটনা খুব স্বাভাবিকভাবে ঘটে। এখানেও তাই ঘটছে। তিনি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন তাঁর মশারির ছাদে একটা সাপ কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। কুণ্ডলি ভেঙে সাপটা মাথা বের করল। এই তো এখন মশারি বেয়ে নিচে নামছে। সাপের গায়ে লম্বা লম্বা দাগ থাকে-এর গায়ে ফুটি ফুটি। অনেকটা চিত্র হরিণের মতো।
তিনি আবারো বিড়বিড় করে বললেন, This is a dream. Nothing but a dream. স্বপ্লের নানান স্তর আছে। তিনি নিশ্চয়ই গভীর কোনো স্তরের স্বপ্ন দেখছেন। এ ধরনের স্বপ্ন চট করে ভাঙে না। মানুষের মস্তিষ্ক স্বপ্নটা পুরোপুরি দেখানোর ব্যবস্থা করে। তার বেলাতেও এই ব্যাপারটিই হচ্ছে। স্বপ্নটা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তাকে দেখতে হবে। তাঁর মস্তিষ্ক দেখাবে। তিনি না চাইলেও দেখাবে।
যদি ঘটনাটা স্বপ্ন হয়ে থাকে তাহলে তার চুপচাপ শুয়ে সাপটার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই। চোখ বন্ধ করলেও সাপটা চলে যাবে না। তাঁর চোখ বন্ধ না করার সঙ্গে স্বপ্নের কোনো সম্পর্ক নেই। আর যদি স্বপ্ন না হয়ে থাকে তাহলে অনেক কিছুই করার আছে। শুয়ে না থেকে তার উঠে বসা দরকার। হাততালি দেওয়া দরকার। সাপ শব্দ পছন্দ করে না। যেকোনো ধরনের কম্পন তার কাছে বিরক্তিকর। খাটটা দোলানো যেতে পারে। বালিশের নিচে সিগারেট আছে। সিগারেট ধরানো যেতে পারে। সিগারেটের ধোয়াও নিশ্চয়ই সাপটা পছন্দ করবে না।
মিসির আলি উঠে বসার সিদ্ধান্ত নিলেন কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও বসতে পারলেন না। এর দুটা কারণ হতে পারে। স্বপ্নে নিজের ইচ্ছায় কিছু করা যায় না। তিনি উঠে বসার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পারছেন না। কাজেই এটা স্বপ্ন। আর স্বপ্ন না হয়ে ঘটনাটা যদি সত্যি হয় তাহলে তিনি উঠে বসতে পারছেন না, কারণ তিনি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছেন। তয়ে স্নায়ুতে স্থবিরতা চলে এসেছে। মস্তিষ্ক উঠে বসার সিগন্যালটা ঠিকমতো দিতে পারছে না। যে সব রাসায়নিক বস্তু নিউরনের বিদ্যুৎপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে তাদের ভেতরের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি বালিশের নিচে হাত দিয়ে সিগারেট নিলেন। সিগারেট ধরালেন। তামাকের গন্ধ পাওয়া গেল। তাহলে কি এটা স্বপ্ন না, সত্যিঃ স্বপ্ন হল সিনেমার পর্দায় ছবি দেখার মতো–ছবি দেখা যাবে, শব্দ শোনা যাবে। তবে কোনো গন্ধ পাওয়া যাবে না। স্বপ্ন গন্ধ এবং বর্ণহীন।
তিনি গন্ধ পাচ্ছেন এবং রঙও দেখছেন। সাপের গায়ের হলুদ ফুটি স্পষ্ট দেখেছেন। এই তো এখন তার হাতে বেনসন এন্ড হেজেস-এর সোনালি প্যাকেট। গাঢ় লাল রঙের উপর লেখা Special filter.
তবে এখানেও কথা আছে, গভীর স্তরের স্বপ্নে বর্ণ গন্ধ সবই থাকে। আচ্ছা এমন কি হতে পারে তিনি যা দেখছেন তা স্বপ্ন না, বাস্তব ঘটনা। তাকে তো আগেই কলা হয়েছে এই বাড়ির দোতলায় সাপ আছে। যদি সাপ থেকেই থাকে তাহলে ঘরে সাপ আসতেই পারে। কারণ এই ঘরটায় কার্বলিক এসিড দেওয়া হয় নি।
ধরে নেওয়া যায় একটা সাপ ঘরে ঢুকেছে। আলো সমস্ত প্ৰাণীকুলকে কৌতূহলী করে, সাপটিকেও করেছে। সে এগিয়ে এসেছে খাটের নিচে রাখা হারিকেনের দিকে। এখানে এসে সে শুনতে পেল নিশ্বাস ফেলার শব্দ। খাট থেকে শব্দটা আসছে। সাপট আবারো কৌতূহলী হল। সে দেখতে গেল ব্যাপারটা কী? কীসের শব্দ? শব্দটা কোত্থেকে আসছে? দেখতে গিয়ে সে চলে গেল মশারির ছাদে। তার কৌতূহল মিটেছে বলে সে এখন চলে যাচ্ছে। কিংবা তার কৌতূহল মেটে নি। সে চলে যাচ্ছে কারণ সে বুঝতে পারছে কৌতূহল মেটার কোনো সম্ভাবনা নেই।
মিসির আলি বিছানায় উঠে বসলেন। বালিশের কাছে হাত বাড়ালেন। টর্চ লাইটটা আছে। তিনি টর্চের আলো ফেললেন। সাপটা দেখা যাচ্ছে না। খাট বেয়ে নিশ্চয়ই নেমে গেছে। তিনি কয়েকবার কাশলেন। টর্চ লাইটে টোকা দিলেন!। বসে বসেই খাট নাড়ালেন। তিনি এখন বিছানা থেকে নামবেন। তাকে একটা কাজ করতে হবে। ছোটখাটো একটা পরীক্ষা। তাকে যেতে হবে বড় টেবিলটার কাছে। টেবিলের উপর ডায়েরি আছে। ডায়েরির পাতায় কিছু একটা লেখে নাম সই করতে হবে।
এই মুহুর্তে যা ঘটছে তা স্বপ্ন না। সত্যি তা প্রমাণ হবে ডায়েরির লেখা থেকে। সকালে ঘুম ভেঙে যদি দেখেন ডায়েরিতে কিছু লেখা নেই তাহলে বুঝতে হবে পুরো ব্যাপারটা স্বপ্ন। আর যদি দেখেন লেখা আছে তাহলে বুঝতে হবে যা দেখেছেন সবই সত্যি। মিসির আলি খুব সাবধানে বিছানা থেকে নামলেন। সাপটাকে প্রথমবার দেখে যে ভয় পেয়েছিলেন, সেই ভয়টা এখন আর লাগছে না। তবে গা ছমছম করছে।
মেঝেতে কোথাও সাপটিকে দেখা গেল না। মিসির আলি টেবিলের কাছে গেলেন। ডায়েরিতে লিখলেন -আজ সাত তারিখ। আমি আমার মশারির উপর একটা সাপ দেখেছি। লিখে নাম সই করলেন। ডায়োরি উন্টে এমনভাবে টেবিলে রাখলেন যেন সকালে ঘুম ভাঙতেই চোখে পড়ে ডায়েরিটা উল্টানো। কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়াবেন। ঘরের ভেতর দমবন্ধ লাগছে।